Post Updated at 21 Jul, 2023 – 10:46 AM
বছরে যে বিশেষ কয়টি দিনে নফল রোজা রাখার কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আশুরার রোজা। হিজরী ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মুহাররমের দশ তারিখকে বলা হয় আশুরা। এই দিনে নফল রোজা রাখা খুবই ফজিলতপূর্ণ একটি আমল। এমনকি বলা চলে, আশুরার নফল রোজাই সবচেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ নফল রোজা। হাদীসের ভাষ্য তো এমনই।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ফরজ নামাজের পর (নফল নামাজের মধ্যে) শ্রেষ্ঠতম নামাজ হচ্ছে গভীর রাতের নামাজ, আর রমজান মাসের রোজার পর (নফল রোজাগুলোর মধ্যে) সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ রোজা হচ্ছে মুহাররম মাসের রোজা। [মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ২৮১৩]
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাস্তব জীবনেও এভাবে আমল করে দেখিয়েছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসের ফরজ রোজা ছাড়া অন্য যেসব দিনে রোজা রাখতেন, সেসব রোজার কোনোটিকেই আশুরার রোজার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে তাঁকে আমি দেখি নি। [বুখারী শরীফ, হাদীস নং ২০০৬]
সাহাবী হযরত আবু কাতাদা আনসারী রা. বলেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশুরার দিনের ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি উত্তরে বলেন, তা বিগত এক বছরের গোনাহ মাফ করিয়ে দেবে। [মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ২৮০৪]
এই রোজাটির প্রেক্ষাপট হিসেবে একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকেই বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করে মদীনায় এলেন, তখন দেখলেন, ইহুদীরা আশুরার দিনে রোজা রাখে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার! তোমরা এই দিনে রোজা রাখ কেন? তারা উত্তরে বলল, ‘এ তো এক মহান দিন। এই দিনে আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা আ. ও তাঁর জাতিকে উদ্ধার করেছিলেন এবং ফেরাউন ও তার জাতিকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাই মুসা আ. কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই দিনে রোজা রাখতেন। (তাঁর অনুসরণ করে) আমরাও এই দিনে রোজা রাখি।’ এই উত্তর শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নবী মুসা আ.এর অনুসরণের ক্ষেত্রে তো আমরাই তোমাদের চেয়ে অধিক যোগ্য ও বেশি হকদার। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এই আশুরার রোজা রাখলেন এবং অন্য মুসলমানদেরকেও তা রাখতে আদেশ করলেন। [বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৩৩৯৭]
উক্ত হাদীসটি থেকে বাহ্যত যদিও প্রতীয়মান হয়—রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আসার পর থেকে আশুরার রোজা রাখা শুরু করেছেন এবং অন্য সাহাবীদেরকে এই রোজা রাখার আদেশ করেছেন, কিন্তু বাস্তবতা এমন নয়। বরং তিনি মদীনায় হিজরতের পূর্বেও মক্কায় থাকাকালীন এই দিনে রোজা রাখতেন। মক্কার কুরাইশ কাফেররাও এই দিনটিকে বিশেষ মর্যাদার সাথে পালন করে আসছিল যুগ যুগ ধরে। এই বিশেষ মর্যাদার দিক লক্ষ করেই তারা এই দিনে পবিত্র কাবা শরীফের পুরনো গিলাফ পরিবর্তন করে নতুন গিলাফ পরানোর আয়োজন করত। তারাও এই দিনে রোজা রাখত। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রীতি ছিল এমন—যখন তিনি কুরাইশদের ভালো কিছু দেখতেন, তখন তিনিও তা পালন করতেন। সেই সূত্র ধরেই তিনিও এই বরকতময় দিনটির রোজা রাখছিলেন মক্কায় অবস্থানকালীন সময় থেকেই।
বুখারী শরীফের এক হাদীসে স্পষ্টভাবেই একথা বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন,
‘আশুরার দিনটি এমন, যাতে জাহেলি যুগে কুরাইশরাও রোজা রাখত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাতে রোজা রাখতেন। যখন তিনি হিজরত করে মদীনায় চলে এলেন, তখনও তিনি এই দিনে রোজা রেখেছেন এবং অন্যদেরকেও রোজা রাখতে বলেছেন।’
এ থেকে বোঝা যায়, মক্কায় থাকাকালীন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের সাথে সাথে আশুরার রোজা রেখেছেন, তবে তিনি তখন কাউকে এ রোজা রাখতে আদেশ করেন নি। পরে যখন মদীনায় আসলেন, তখন নিজে রাখার পাশাপাশি অন্যদেরকেও রোজাটি রাখতে আদেশ করলেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফের কোনো কোনো হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী—রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রোজাটির উপর এতই জোর দিতেন যে, একবার তিনি আশুরার দিনে মদীনার ঘরে ঘরে সংবাদ পাঠালেন যে আজ সকাল থেকে কিছু খায় নি কিংবা পান করে নি, সে যেন আজকের রোজা রাখে, আর যদি কেউ কিছু খেয়েও থাকে, তবু যেন অবশিষ্ট সময়টুকু সে না খেয়েই কাটায়। এ থেকে কেউ কেউ বলেন, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার রোজাই ফরজ ছিল। পরে যখন রমজান মাসের রোজাই ফরজ হয়ে গেল, তখন আশুরার রোজাটি ঐচ্ছিক হয়ে যায়—কেউ চাইলে রাখে, কেউ রাখে না।
আরেকটি হাদীসে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশুরার রোজা সম্পর্কে বললেন, এই দিনকে তো ইহুদী ও খৃস্টানরাও সম্মান করে। সাহাবীদের এই অভিযোগ শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমি অবশ্যই নয় তারিখে রোজা রাখব। [মুসলিম শরীফ]
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় কেউ কেউ এমনও বলেছেন—শুধু নয় তারিখে একটি রোজা রাখলেই হবে। কিন্তু অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মত হচ্ছে, শুধু নয় তারিখে নয়, বরং দশ তারিখের সাথে মিলিয়ে নয় তারিখেও একটি রাখবে। যেন ইহুদী-খৃস্টানদের সাথে আমলের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা থাকে। কেউ নয় তারিখের রোজাটি রাখতে না পারলে আশুরার পরের দিন অর্থাৎ এগার তারিখেও রোজা রাখতে পারে। এতেও হাদীসের উদ্দিষ্ট বিষয় অর্থাৎ ইহুদী-খৃস্টানদের সাথে ভিন্নতার প্রকাশ ঘটবে।
সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারী-তে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. লিখেছেন : আশুরার রোজা তিন স্তরের। সর্বনিম্ন স্তর হলো একদিন রোজা রাখা, এর উপরের স্তর দশ তারিখের আগে নয় তারিখেও রোজা রাখা, এর উপরের স্তর হলো নয়-দশ-এগার এ তিন দিন রোজা রাখা। [বাবু সিয়ামি ইয়াওমি আশুরা]
আমাদের ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত মনীষী মাওলানা মনজুর নুমানী বলেছেন, বর্তমান সময়ে যেহেতু ইহুদী-খৃস্টানরা এই আশুরার দিনে রোজাই রাখে না এবং তারা চান্দ্র মাস হিসেবে কোনো কিছু হিসাবও করে না, বরং সবকিছুই ইংরেজি মাস হিসেবে করে থাকে। তাই এখন তাদের সাথে ভিন্নতা প্রকাশের জন্যে আশুরার রোজার সাথে আগে বা পরে একটি রোজা যোগ করার প্রয়োজন নেই বলেই আমি মনে করি। [সূত্র: মাআরিফুল হাদীস, খ.৪, পৃ.৩৮৭]
বোঝা গেল, আশুরার রোজা একটি রাখলেও চলবে। তবে দুটি রাখলে ভালো, তিনটি রাখতে পারলে বেশি ভালো।
আশুরার রোজার ইতিহাস জানতে আমাদের ব্লগের এ লেখাটি পড়ুন।
এ বিষয়ে আরো জানতে নিচের লিংকগুলো ভিজিট করুন:
প্রবন্ধের লিংক:
- মুহাররম ও আশুরা – কিছু কথা ও কিছু প্রশ্নের উত্তর – মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
- মুহাররম ও আশুরা : গুরুত্ব ও ফযীলত – মাসিক আলকাউসার
- আশুরা ও মুহাররমঃ কিছু কথা – মাসিক আলকাউসার
- মুহাররমের প্রথম দশ দিন রোযা রাখার ফযীলত সম্পর্কে একটি ভিত্তিহীন বর্ণনা
- আহলে বাইতের দৃষ্টিতে মাতম [শিয়াদের বর্ণনার আলোকে] – মাসিক আলকাউসার
- স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর শোক পালনের সময়কাল – মাসিক আলকাউসার
- একটি ভুল ধারণা : মুহাররম মাসে বিবাহ করা কি অশুভ
ইউটিউব ভিডিও এর লিংক:
- আশুরার দিনে যে কাজগুলো নিষিদ্ধ – মাওলানা তাহমীদুল মাওলা
- ইসলামে আশুরার আমল – মাওলানা তাহমীদুল মাওলা
- ইসলামে আশুরার এত গুরুত্ব কেন? – মাওলানা তাহমীদুল মাওলা
- মুহাররম ও আশুরা: করণীয় ও বর্জনীয় – মাওলানা মাসীহুল্লাহ হাসান
Comments (6)
Harun ar rashidsays:
July 29, 2023 at 4:43 AMআমি মুসলিম ডে কে পছন্দ করি সাথে আছি থাকব।
Sharmin Akhter Lilysays:
July 29, 2023 at 10:21 PMInshallah onk valo
Parvezsays:
July 31, 2023 at 5:37 PMAlhamdulillah, vhalo dik nirdeshona royesa.
Saifullahsays:
July 6, 2024 at 10:36 PMAlhamdulillah
Shapla parvinsays:
July 7, 2024 at 11:40 PMLike
umme faiyazsays:
July 9, 2024 at 5:50 PMআসসালামু আলাইকুম।
সমাধান দিলে অনেক উপকৃত হব।
★কাযা রোজা থাকা অবস্থায় কি নফল রোজা রাখা যাবে?
★নাকি কাযা রোজা আগে শেষ করতে হবে?
★বছরের বিশেষ দিনগুলি তে (যেমন আশুরা,শবে-বরাত,বা জিলহজ্জ মাসের ১ম ১০ দিন) কাযা রোজার নিয়ত করলে সেই দিনের ফযিলত পাওয়া যাবে?
মাওলানা শিব্বীর আহমদsays:
July 16, 2024 at 3:43 PMওয়াআলাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ
স্বাভাবিক অবস্থায় তো আগে কাযা, এরপর নফল রোজা রাখবে। কাযা রোজা যেহেতু ফরয, তাই আগে সেটাই আদায় করবে। তবে যেসব নফল নির্দিষ্ট কোনো দিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেমন আশুরা কিংবা শাওয়ালের ছয় রোজা, সে ক্ষেত্রে ফরজ কাযা রোজা বাকি থাকা অবস্থায়ও নফল রোজা রাখা যাবে। আর যেসব নফল রোজার বিশেষ ফযিলত রয়েছে, সেগুলোতে কাযা রোজার নিয়ত করলে নফল রোজার ফযিলত না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
Farjanasays:
July 10, 2024 at 5:27 AMInshaallah
Sakib Uddinsays:
July 10, 2024 at 11:07 AMInformative. Jazakakkah khair
MD ESMAILsays:
July 11, 2024 at 9:26 AMআলহামদুলিল্লাহ
Jubayar Al Mahmudsays:
July 12, 2024 at 6:31 PMআলহামদুলিল্লাহ
ANUAR HOSSAINsays:
July 13, 2024 at 7:53 PMআলহামদুলিল্লাহ, এই অ্যাপসের মাধ্যমে আমি কিছুই জানতে পেরেছি
Bonna aktersays:
July 14, 2024 at 12:29 AMAlhamdulillah
মোঃ হোসাইনsays:
July 16, 2024 at 3:59 AMআলহামদুলিল্লাহ
Habib MD Jahad mazumdersays:
July 16, 2024 at 9:41 AMMasallah masallah
umme faiyazsays:
August 7, 2024 at 11:59 AMজাজাকাল্লাহ খাইরান।
আলহামদুলিল্লাহ। উম্মতের এই কঠিন সময়ে আপনাদের মেহনত খুবই উপকারী।
আল্লাহ তা’লা আপনাদের এলেম,আমল ও মেহনতে বরকত দান করেন।আমিন