Post Updated at 30 Apr, 2023 – 7:59 PM

শিল্পবিপ্লব বলে একটি কথা আছে। খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে এই বিপ্লবের ছোঁয়ায় ইউরোপের জীবনযাত্রা সমাজ অর্থনীতি আন্দোলিত হয়ে উঠল প্রবলভাবে। এর প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে সেখানকার মানুষেরা পেল বহুমাত্রিক আরাম-আয়েশ আর অধিকতর সহজতার সন্ধান। সমৃদ্ধ হলো তাদের অর্থনীতি। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকে ক্রুসেড যুদ্ধের ভেতর দিয়ে তারা সুযোগ পেয়ে যায় সভ্যতার আলোয় আলোকিত মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশার। এরই ফলশ্রুতিতে জেগে ওঠে তাদের সুপ্ত প্রতিভা। চিন্তা-চেতনা সভ্যতা আর কাজে-কর্মে তারা এগিয়ে যেতে থাকে বহুদূর। অষ্টাদশ শতকের শিল্পবিপ্লব এর ধারাবাহিকতারই ফসল। কিন্তু ওহির আলো থেকে বঞ্চিত থাকার দরুন তাদের এ অগ্রযাত্রার একটি ভিন্ন রূপও প্রকাশ পায়। সৃষ্টি হয় বেকারত্ব। বাড়তে থাকে অসহায় মানুষের সংখ্যা। বড় বড় শিল্পকারখানার জোয়ারে ভেসে যায় কুটির শিল্প। দিনে দিনে প্রকট হতে থাকে ধনী-গরীবের মধ্যকার বৈষম্য। মানবতা ও বিবেক হারিয়ে ধনী মানুষেরা নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় হয়ে ওঠে হিংস্র ও নির্মম। আর জুলুম-নিপীড়নে অতিষ্ট হতে হতে মজুর শ্রেণির মানুষেরা হতে থাকে আন্দোলনমুখর।

আন্দোলনের নামে গড়ে ওঠে তাদের বিভিন্ন সংগঠন। ধীরে ধীরে এ দুই শ্রেণির মধ্যকার সম্পর্ককে তিক্ত থেকে তিক্তকর করে দিয়ে পরস্পরকে মুখোমুখি এবং আগ্রাসী ও মারমুখী করে তোলাও এ বিপ্লবেরই পরোক্ষ ফসল। যে কারখানায় শ্রম বিলিয়ে একজন শ্রমিক সংগ্রহ করে বেঁচে থাকার অবলম্বন, সামান্য সুযোগ পেলেই রাজপথ দখলে নিয়ে কাঁচ দিয়ে নির্মিত সে কারখানার দেয়ালে ইট-সুরকি-পাথর মেরে ভেঙ্গে দিতে মোটেও তাকে ভাবতে হয় না। শ্রমিকদের দেয়া আগুনেই পুড়ে ছাই হয় কারখানার মেশিনপত্র। দোর্দ- প্রতাপশালী মালিক তখন অসহায় অশ্রুবর্ষণ ছাড়া আর কোনো পথই খুঁজে পায় না। এ কোনো কল্পকাহিনী নয়, বরং আমাদের এ দেশেই নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া বাস্তবতা।

 

বলাবাহুল্য, আজকের আধুনিক পৃথিবীজুড়ে মে মাসের পয়লা তারিখে পালিত শ্রমিক দিবস এ শিল্পবিপ্লবেরই এক পরোক্ষ পরিণতি। ধনিক-বনিকদের আগ্রাসী ও শোষণমুখী মানসিকতাই দরিদ্র শ্রমিকগোষ্ঠীকে নামিয়ে এনেছিল রাজপথে। বর্তমানে যেমন হয়, তেমনি। ১৮৮৬’র এমনি এক আন্দোলনমুখর দিনে মে মাসের প্রথম তারিখে আমেরিকার শিকাগোর রাজপথ ভেসে যায় রক্তে, পুলিশের গুলিতে প্রাণহারানো অসহায় শ্রমিকদের রক্তে।

২.
অথচ এ শিল্পবিপ্লবের প্রায় তেরশ বছর পূর্বে আমাদের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদূর ভবিষ্যত পর্যন্ত অনাগত মানবতার সামনে যে মৌলিক নির্দেশনা অঙ্কন করে গেছেন, যে শিক্ষা ও আদর্শের ছাঁচে তিনি গড়ে রেখে গেছেন তাঁর অনুসারীদের, সে আদর্শে সে শিক্ষা ও নির্দেশনায় এমন দ্বন্দ্বমুখর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সামান্যতম আশংকাও নেই। ইসলামে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক খুবই ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত

শুধু শ্রমিক-মালিক কেন, সামাজিক জীবনে আমাদেরকে প্রতিনিয়তই দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে যেতে হয়। কেউ ক্রেতা তো কেউ বিক্রেতা, কেউ ছাত্র তো কেউ শিক্ষক, কেউ রাজা হলে কেউ প্রজা, ঠিক তেমনি কেউ মালিক হলে কেউ শ্রমিক হবে। আবার একজন মানুষ যে প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বদা একই পক্ষে অবস্থান নেবে এমনও নয়। একজন সবসময় শুধু ব্যবসা-ই করে যাবে, কখনো কারও কাছ থেকে কোনো কিছু কিনতে যাবে না—এটা হতে পারে না। বরং একজন এক বাজারে বিক্রেতা হলে দেখা যায় সে অন্য বাজারের ক্রেতা। আজ কেউ একজন সাধারণ প্রজা, কাল সে হয়ে যেতে পারে রাজা। রাজার কুরসিতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগে রাজা হয়ে যান একজন সাধারণ নাগরিক। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেখে যাওয়া আদর্শে আদর্শবান যারা, তারা আমাদের বাস্তবজীবনের এমন কোনো ক্ষেত্রেই একজন অপরজনকে প্রতিপক্ষ মনে করবে না। বরং তাদের জন্যে শিক্ষা—জীবন চলার পথে তারা যেন একে অন্যকে একই পথের পথিক মনে করে, মনে করে একই গাড়ির পাশাপাশি আসনে বসা সহযাত্রী। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যেমন এগিয়ে যায় সমাজ, তেমনি সকলের হৃদ্যতা ও বিশ্বাসপূর্ণ আচরণেই বইতে থাকে সমাজজুড়ে শান্তির নির্মল বাতাস। এ আদর্শে দীক্ষিত করার মতো পবিত্র কুরআন ও হাদীসে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নির্দেশনা, অসংখ্য উপমা।

একটি মৌলিক উপদেশ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কণ্ঠেই শুনুন—‘দীন হচ্ছে কল্যাণকামিতার নাম।’ এ বাণী শুনে উপস্থিত সাহাবীগণ জানতে চাইলেন—এ কল্যাণকামিতা কার জন্যে, ইয়া রাসূলুল্লাহ? তিনি বলে দিলেন, ‘আল্লাহর জন্যে, তাঁর কিতাবের জন্যে, তাঁর রাসূলের জন্যে, মুসলমানদের ইমাম তথা শাসকদের জন্যে এবং সাধারণ জনগনের জন্যে।’ [সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৫৫; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪৩] অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদে বিশ্বাস রাখবে, গোপনে হোক আর প্রকাশ্যে হোক, তাঁর সামনে প্রকাশ করবে বিনয়ের পরাকাষ্ঠা, তাঁর আদেশসমূহ মেনে চলে দূরে থাকবে তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়াদি থেকে, প্রয়োজনে তাঁর দীন রক্ষার তাগিদে পাপীষ্ঠ বেদ্বীনদের বিরুদ্ধে জিহাদে ঝাপিয়ে পড়তে হবে—এই হলো আল্লাহর জন্যে কল্যাণকামিতা।

তিনি যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, সেগুলো পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা, যথাযথভাবে তা তেলাওয়াত করা আর সবধরনের বিকৃতি থেকে তা হেফাজত করতে সচেষ্ট থাকাই হলো কিতাবের জন্যে কল্যাণকামিতা। তেমনিভাবে আল্লাহতায়ালার প্রেরিত রাসূলগণের সার্বিক সহযোগিতা, তাঁদের সুন্নতের প্রতি যত্নবান থাকা আর কথায় কাজে আদর্শে ভালোবাসায় তাঁদের অনুসরণই হলো তাঁদের প্রতি কল্যাণকামিতা। নেতৃস্থানীয় ইমামগণের কল্যাণকামিতা হিসেবে মেনে চলতে হবে তাঁদের ফরমান ও বিধিনিষেধ। আর জনসাধারনের প্রতি কল্যাণকামিতা! তা হলো তাদের কল্যাণের দিকে লক্ষ রেখে তাদের উপকার সাধন এবং তাদেরকে উপকারী ও কল্যাণকর বিষয়াদি শিখিয়ে দিতে আর সবধরনের অপ্রীতিকর ও অবাঞ্ছিত বিষয়াদি থেকে তাদেরকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট থাকা, সর্বোপরি নিজের জন্যে যা কাক্সিক্ষত, অন্যদের জন্যেও তারই কামনা করা। [ফাতহুল বারী থেকে সংক্ষেপিত]

এ আদর্শিক দীক্ষা যারা গ্রহণ করবেন, তারা যদি ক্রেতা হয়ে থাকেন তাহলে তারা যেমন বিক্রেতাকে ধোঁকায় ফেলে জাল টাকা ধরিয়ে দিতে কিংবা কোনো ধরনের অসত্য বলে তাকে প্রভাবিত করতে পারেন না, তেমনি তারা যখন বিক্রেতা, তখনো তারা ক্রেতাকে মাপে কম দেয়া কিংবা ভালো পণ্যের আড়ালে ভেজাল পণ্য তার হাতে তুলে দিতে পারেন না। এ ধারার শ্রমিক যারা, তাদের হাতে মালিকের সম্পদ পবিত্র আমানত। বিশ্বস্ততার ওপর ভর করেই মালিক তাদের হাতে নিজের সম্পদ তুলে দেয়। তাই শ্রমিক এখানে এ আমানত রক্ষা করতে সদা দায়বদ্ধ। এর বিপরীতে, যারা মালিক তারাও আদিষ্ট শ্রমিকের যথাযথ পাওনা পরিশোধ করতে, তার অসহায়ত্বকে পুঁজি না করে তার শ্রম আর ঘামের ন্যায্য মূল্য তাকে দিয়ে যেতে। এই হলো ইসলাম। এমন সহযোগিতা সহমর্মিতা আর কল্যাণকামিতার রসে সিক্ত এখানকার মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক। চারিদিকে যখন বইতে থাকে সুসম্পর্কের এমন স্নিগ্ধ বাতাস, তখন একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী আর আন্দোলনমুখর হয়ে ওঠার সুযোগ কোথায়?

বাংলায় শ্রমিক আর ইংরেজিতে labour বলে যা বোঝানো হয়, আরবিতে অবশ্য ‘আজীর’ শব্দটি এর চেয়ে অনেক ব্যাপক অর্থবোধক। কায়িক শ্রম দিয়ে শরীরের রক্তকে নোনতা ঘামে ঝরিয়ে দিয়ে যে জীবিকা নির্বাহ করে সেই শ্রমিক বা লেবার। আর ‘আজীর’ হলো বেতনভুক্ত কিংবা বিনিময় প্রদানের চুক্তিতে নিয়োজিত ব্যক্তি। তাই ‘আজীর’ শব্দে যে শ্রেণির কথা হাদীসে বলা হয়েছে, তারা কেবল সমাজের নিম্ন শ্রেণির খেটে খাওয়া অসহায় মজুর শ্রেণিই নয়, বরং তাদের পাশাপাশি ইজি চেয়ারে বসে এসিযুক্ত ঝকঝকে মনোরম পরিবেশে পরিচ্ছন্ন পরিপাটি পোশাকে যারা সরকারি কিংবা বেসরকারি বিভিন্ন অফিসে উচ্চ বেতনে চাকুরি করেন তারাও ‘আজীর’। যারা ‘আজীর’, তাদের সঙ্গে কৃত চুক্তি অনুসারে তাদের পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে তাদের শারীরিক কিংবা মানসিক ক্লান্তির রেশ হারিয়ে যাওয়ার পূর্বেই। হাদীসের ভাষ্য কত পরিষ্কার—‘শ্রমিকের পাওনা (এত দ্রুত) মিটিয়ে দাও, যেন এর পূর্বে তার ঘামও না শুকিয়ে যেতে পারে!’ [সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস : ২৪৪৩]

মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকেই মানুষের মাঝে ধনী-গরিব সচ্ছল-অসচ্ছল মালিক-শ্রমিকের একটি রেখা এঁকে দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে তিনি সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন—আমিই পার্থিব জীবনে তাদের মাঝে তাদের জীবিকা বণ্টন করি এবং একজনকে অপরের ওপর মর্যাদায় উন্নত করি, যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে। [সুরা যুখরুফ, আয়াত : ৩২] পারস্পরিক যে নির্ভরশীলতার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে মানবসমাজ, সে নির্ভরশীলতা টিকে থাকার অপরিহার্য মাধ্যম এই ব্যবধান। এ ব্যবধানের কারণেই প্রয়োজনের তাগিদে গরিব-অসচ্ছল ব্যক্তি যেমন ধনীদের কাছে যায়, তেমনি ধনী ও সচ্ছল যারা, তারাও গরিব অসচ্ছল ব্যক্তিদের খোঁজে বের হয়। সমাজ টিকে থাকার জন্যে শ্রমিক-মালিকের এই ব্যবধান ও সহাবস্থান অনস্বীকার্য। যদি কোথাও এ ব্যবধানরেখা মুছে যায়, যদি কোনো সমাজে শ্রমিকের কোনো অস্তিত্ব না থাকে, বরং সকলেই মালিকপক্ষ হয়ে যায়, কিংবা কোথাও যদি শ্রমিককে কাজে নিয়োজিত করার মতো কোনো মালিক না থাকে, তাহলে সেখানে কি শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন সম্ভব হবে? মালিককেই যদি শ্রমিকের কাজ করতে হয় তাহলে কেমন হবে? বাধ্য হয়েই তখন তাদেরকে অন্য কোথাও থেকে হলেও শ্রমজীবী মানুষদেরকে নিয়ে এসে উক্ত ব্যবধানটি সৃষ্টি করতে হবে।

যেহেতু এই উভয় শ্রেণির অস্তিত্বের ওপরই সমাজের অস্তিত্ব নির্ভর করে, তাই ইসলাম উভয়কেই মানবিক ও আদর্শিক আচরণের দীক্ষা দিয়েছে। কোথাও আদেশের সুরে, কোথাওবা উপদেশের সুরে উভয়ের জন্যেই ইসলামের নির্দেশনা—যেন সবাই নিজের দায়িত্ব ও অন্যের হক আদায়ে যতœবান হয়। ওপরে আমরা পারস্পরিক কল্যাণকামিতার যে হাদীসটি উল্লেখ করে এসেছি, তা এরই একটি দৃষ্টান্ত। তাই কেউ শ্রমিক হোক কিংবা মালিক হোক, একে অন্যের মঙ্গল ও কল্যাণের দিকে লক্ষ রাখবে অবশ্যই। এই হচ্ছে ইসলামের আদর্শ।

বাহ্যত মালিক পক্ষ ও সচ্ছল শ্রেণির প্রতি শ্রমিক ও অসচ্ছল লোকেরা একটু বেশি নির্ভরশীল। নিজেদের জীবিকার তালাশে কাজের খোঁজে তাদের ঘুরে ফিরতে হয় ধনীদের দুয়ারে দুয়ারে। ধনীদের অধীনে কাজ করে শ্রম খাটিয়ে তারা উপার্জন করে নিজেদের জীবিকা। এ বাহ্যিক দিকে চোখ রেখে ধনী ব্যক্তিরাও মনে করতে পারে—এই অসচ্ছল শ্রেণি তো আমাদের কাজকর্ম করেই নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। ইসলামের অমর নির্দেশনায় এই বাহ্যিক দিকটিও সযতেœ লক্ষ রাখা হয়েছে—তারা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। আল্লাহ যদি কারও ভাইকে তার অধীন করে দেন, তাহলে সে নিজে যা আহার করে, তার ভাইকেও যেন তা থেকেই আহার করায়। সে নিজে যে কাপড় পরে, তাকেও যেন তা থেকেই পরতে দেয়। সাধ্যাতীত কোনো কঠিন কাজের বোঝা যেন সে তার ওপর চাপিয়ে না দেয়। আর যদি কোনো কঠিন কাজ করতে দেয়, তাহলে যেন তাকে সে কাজে সহযোগিতা করে। [সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬০৫০]

এই হচ্ছে ইসলাম। এখানে শ্রমিক-মালিকের ব্যবধানকে অস্বীকার করা হয় নি। আবার শ্রমিককে অধীনস্থ মনে করে অন্যায়ভাবে তার ওপর কঠিন কঠিন সব কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতেও নিষেধ করা হয়েছে। যে রক্ত-মাংসে গড়া একজন মালিকের দেহ, ঠিক সেই একই রক্ত-মাংসে গড়া একজন শ্রমিকের দেহও। মানুষ হিসেবে একজন মালিকের যতরকম চাহিদা রয়েছে, ঠিক একজন শ্রমিকেরও সেসব চাহিদা রয়েছে। এমনকি শ্রমিক যদি কৃতদাস হয় তবুও। তাই হাদীসের নির্দেশনা—‘তারা তোমাদের মতোই মানুষ। তারা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কেবল তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তাই বলে তাদের শারীরিক ও মানসিক চাহিদাগুলো রহিত হয়ে যায় নি। নিজেরা তোমরা যে খাবার খাবে, তাদেরকেও তা থেকে খাওয়াবে, নিজেরা যে কাপড় পরবে, তাদেরকেও তা পরাবে।’

ইসলামের সাম্যবাদী শিক্ষায় উচ্চ বেতনে নিয়োজিত কোনো অফিসের ম্যানেজার আর রোদে পুড়ে ধান ক্ষেতে ধান কাটায় নিয়োজিত মজুর—তাদের অধিকারের মাঝে কোনো ফারাক রাখা হয় নি। অন্যের চাকরি করেও অফিসার যদি সম্মানজনক জীবন লাভ করতে পারে, তাহলে দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ যারা, তাদেরও অধিকার রয়েছে সমাজে মাথা উঁচু করে দাড়াবার। শিক্ষিত-অশিক্ষিত ধনী-গরীবের মধ্যকার পার্থক্য সামাজিক সম্মান নির্ধারণে ভূমিকা রাখে যথেষ্ট, তাই বলে অধিকারের প্রশ্নে অশিক্ষিত দরিদ্র আর নি¤œশ্রেণির কাউকে অবহেলা করা হবে—সে সুযোগ নেই।

শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠী কেন, যারা কৃতদাস, আইনে যাদের নিজসত্তার মালিকানাটুকুও বলতে গেলে নেই, তাদের অধিকারও তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে। নিজ শ্রম মেধা চেষ্টা আর সাধনায় কৃতদাসও হতে পারে অনন্য সম্মানের অধিকারী। ইসলামের বর্ণিল ইতিহাস এমনই। উমাইয়া বাদশাহ আবদুল মালিক একবার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে শিহাব যুহরী রহ.এর নিকট জানতে চেয়েছিলেন—পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানদের নৈতিক নেতৃত্ব কাদের হাতে? তার জানার বিষয় ছিল, এ নেতৃস্থানীয় মনীষীগণ আরবের একেকটি অভিজাত বংশের সন্তান, না আজাদকৃত দাস। হযরত ইবনে শিহাব যুহরী রহ. বাদশার প্রশ্নের উত্তরে একে একে বলে গেলেন—এ নেতৃত্বের আসনে আসীন মক্কার আতা ইবনে আবী রাবাহ, ইয়েমেনের তাউস ইবনে কায়সান, মিশরের এজিদ ইবনে হাবীব, সিরিয়ার মাকহুল, দজলা-ফুরাত নদী বিধৌত অঞ্চলের মায়মূন ইবনে মেহরান, খুরাসানের জাহহাক ইবনে মুজাহিম, বসরার হাসান ইবনে আবুল হাসান আর এঁরা সকলেই আজাদিপ্রাপ্ত দাস। অবশেষে আবদুল মালিক জানতে চাইলেন, কুফার নেতৃত্ব কার হাতে? যুহরী রহ. জানালেন, এখানে নেতৃত্বের আসনে রয়েছেন ইবরাহীম নাখায়ী এবং তিনি আরবীয় এক সম্ভ্রান্ত আলেম। বাদশাহ আবদুল মালিক বললেন, ‘উহ! এতক্ষণে এমন একটি কথা শোনালেন, যাতে আমার মনের কালো ছায়াটা সরে যেতে পেরেছে। একথা যদি না বলতেন তাহলে আমার কলিজাটা ফেটে যেত।’ [মারিফাতু উলূমিল হাদীসের সূত্রে ইসলামে শ্রমিকের অধিকার (সংক্ষেপিত), পৃ. ৭৫-৭৬]

৩.
বর্তমান আধুনিক বিশ্বকে শাসিয়ে বেড়াচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি। অথচ এর পরোক্ষ পরিণতি কত ভয়াবহ তা আমরা শুরুতে বলে এসেছি। এখানে আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি—ব্রাজিলে একবার ফলন বেশি হলে আতঙ্কিত মনে পুঁজিপতিরা পরামর্শে বসে, ‘কী করা যায়?’ উদ্বৃত্ত ফসল এতো বেশি যে তা মাটিতে পুঁতে রাখার মতো জায়গা নেই। পানিতে ফেলে দিলে জলজ সম্পদ মাছের ক্ষতি হতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত হলো—সেগুলো পুড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু বিশাল সবুজ শ্যামল শস্যক্ষেত্র জ্বালিয়ে দেয়াও তো সহজ ছিল না। তবু পেট্রোল ধরিয়ে সব ছাই করে দেয়া হলো। এতে তেল ব্যয় হয়েছিল প্রায় দুই লাখ পাউন্ড। [ওহংরফব খধঃরহ অসবৎরপধ’র সূত্রে ইসলামে শ্রমিকের অধিকার] সেই ধনিক শ্রেণির লক্ষ্যই ছিল—কিছুতেই যেন শ্রমিকরা স্বাবলম্বী হতে না পারে। এ লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে তারা যেমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করত, তেমনি সর্বতোভাবে চেষ্টা করত শ্রমিকদের দরিদ্রতা ও অসহায়ত্বকে স্থায়ী করে রাখতে। এটাই ছিল তাদের দর্শন। ম্যানডেভিলের ভাষায়—‘গরিবদের থেকে কাজ নেয়ার একটি মাত্র পথ, আর তা হলো এদেরকে দরিদ্র থাকতে দাও। এদেরকে পরনির্ভরশীল করে তোলো। এদের প্রয়োজন খুব অল্প করেই পূরণ করা দরকার। আপন প্রয়োজন পূরণে এদেরকে স্বাবলম্বী করে তোলা চরম বোকামী।’ [ঋধনষব ড়ভ ঃযব নববং এর সূত্রে ইসলামে শ্রমিকের অধিকার]

পুঁজিবাদী এই নিষ্ঠুরতা থেকে শ্রমিকদেরকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠে আরেক অর্থব্যবস্থা—সমাজতন্ত্র। এর মূলকথা ছিল—‘সমাজে অর্থনৈতিক বা সামাজিক বৈষম্য থাকবে না। শোষক পুুঁজিপতি থাকবে না। বরং প্রত্যেকেরই যোগ্যতানুযায়ী কাজ নেয়া হবে এবং প্রত্যেককে প্রয়োজনীয় ভরণ-পোষণ দেয়া হবে।’ কার্ল মার্কসের এই দর্শনকে, অনেকটা এড়িয়ে গিয়ে হলেও, প্রথম বাস্তবে রূপদান করেন তার চিন্তাধারায় গভীরভাবে প্রভাবিত সমাজতন্ত্রীদের প্রথম বিপ্লবী নায়ক অর্থনীতিবিদ ভি আই লেনিন। রাশিয়ায় তিনি সমাজতান্ত্রিক শাসন কায়েম করতে সচেষ্ট হন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যে শোষণ ও বৈষম্যের অক্টোপাস থেকে অসহায় শ্রমিকদেরকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, সেই রাষ্ট্রের শ্রমিকরা উল্টো আরও বেশি শোষণের শিকার হতে থাকে। মানবতা সেখানে আরও অসহায় হয়ে পড়ে। কিছুদিনের ব্যবধানে সেখানেও পুঁজিবাদের মতো যোগ্যতা অনুসারে মজুরির প্রথা চালু হয়। অসহায় মানবতাকে মুক্তির স্বাদ দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয় খোদায়ী আলোক-বিবর্জিত এই নতুন দর্শন।

৪.
মানবতার কল্যাণসাধনে মানুষের চেষ্টা লক্ষ করা যায় প্রতি যুগেই। কিন্তু সে চেষ্টায় যদি অহির আলোর মিশ্রণ না থাকে, তাহলে সব চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। পুুঁজিবাদ আর সমাজবাদই এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তাই শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের অবশ্যই ইসলামের আদর্শকেই বেছে নিতে হবে। ধনিক শ্রেণির শোষণমূলক মনোভাব পরিহার করতে হবে। শ্রমিকের পাওনা প্রদানের ক্ষেত্রে তাকে একজন মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে, হাতিয়ার হিসেবে নয়। তাহলে শ্রমিকপক্ষও কাজে আন্তরিক হবে। তাদের হাতে নিরাপদ থাকবে তাদের জীবিকার অবলম্বন মালিকের কারখানা-ফ্যাক্টরি সহায়-সম্পদ। সমাজে শান্তির হাওয়া বইবে।

ভারতের বিখ্যাত মনীষী মাওলানা ওবাইদুল্লাহ সিন্ধি বলেছেন, ‘আমার রাশিয়া অবস্থানকালে লেনিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে কথাপ্রসঙ্গে তার কাছে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি বিশ্লেষণ করি—(অর্থ) হে নবী! আপনার কাছে লোকেরা এসে জিজ্ঞেস করে—তারা আল্লাহর পথে কী ব্যয় করবে? আপনি বলে দিন, প্রয়োজনাতিরিক্ত সবকিছু বিলিয়ে দাও।’ তখন লেনিন অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আরও আগে যদি কুরআনের এই সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতাম, তাহলে আমাদের ‘কম্যূনিজম’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কোনো আবশ্যিকতাই ছিল না।’ [মাওলানা শামসুল হক আফগানী কৃত ‘পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইসলাম’এর সূত্রে ইসলামে শ্রমিকের অধিকার]

Comments
  1. একটা প্রশ্ন করেছিলাম, যার উত্তর এখনও পাই নাই।

    1. আপনার পূর্ববর্তী কোনো কমেন্ট খুঁজে পাচ্ছি না।

  2. মেয়েরা ভাঙগতি রোজার না রেখে আগে শাওয়াল মাসের রোজা রাখতে পারবে?

    1. পারবে, তবে ভাংতিগুলো আগে রেখে পরে শাওয়ালের রোজাগুলো রাখতে পারলে বেশি ভালো হয়।

  3. অনেক সুন্দর।

  4. শাওয়ালোর রোজা রাখার নিয়ম কি??

  5. নামাজরত অবস্থায় ধাতু ভাঙ্গে পড়লে নামাজ হবে কি না পুনরায় কি করতে হবে একটু বলবেন
    মহিলাদের ক্ষেত্রে

    1. ওজু ভেঙে যাবে। নতুন করে ওজু করে নামাজ পড়তে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

সাম্প্রতিক পোস্ট সমূহ
ক্যাটাগরি সমূহ
ট্যাগ সমূহ
error: অনুগ্রহ করে লেখাটি কপি করবেন না। লিংক শেয়ার করুন। ধন্যবাদ