Post Updated at 29 Jun, 2024 – 7:59 AM

যঈফ হাদীসের স্বরূপ

যঈফ শব্দের অর্থ দুর্বল। যঈফ হাদীস কথাটির আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় দুর্বল হাদীস। তবে যঈফ হাদীস মানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো কথা দুর্বল বা অগ্রহণযোগ্য; বিষয়টি এমন নয়।  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো কথা দুর্বল হতে পারে না।  আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতিটি কথা উম্মাহর জন্য আদর্শ। প্রতিটি বাণী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার পক্ষ হতে ওহী।

 

মূলত হাদীস যঈফ হওয়া মানে হাদীসের সনদ বা সূত্রের দুর্বলতা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে রেকর্ড করার আধুনিক কোনো প্রযুক্তি যদিও ছিল না, কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে মুহাদ্দিসগণ যুগের পর যুগ একে অপরের থেকে মুখস্থ করে, লিখে পরম যত্ন সহকারে তা সংরক্ষণ করেন। হাদীস সংরক্ষণের এই ধারাবাহিকতা এভাবেই যুগের পর যুগ চলতে থাকে।

সংরক্ষণের এই সূত্র বিবেচনায় হাদীসের তিনটি প্রকার নির্ধারণ করা হয়েছে- (১) সহীহ, (২) হাসান, (৩) যয়ীফ। যে হাদীসের সূত্র সর্বোচ্চ মানে উত্তীর্ণ সেটা সহীহ। যে হাদীসের মান এরচেয়ে একটু কম, তা হাসান। আরও কম হলে যঈফ। ইমাম নববী রহ. এর মতে যঈফ হাদীস হলো –

وهو ما لم يجمع صفة الصحيح أو الحسن

অর্থ: যে হাদীসে সহীহ কিংবা হাসানের শর্তাবলি বিদ্যমান নেই অর্থাৎ যে হাদীসটি সহীহও নয়; হাসানও নয় তাকে যঈফ হাদীস বলে। (আততাকরীব ওয়াত তাইসীর – ১/১৯৫)

হাদীস যঈফ হওয়ার কারণ

হাদীস যঈফ হওয়ার কারণ মূলত ‍দুটি:

  1.  হাদীসের সনদ থেকে কোনো বর্ণনাকারী পড়ে যাওয়া। অর্থাৎ হাদীস বর্ণনার সূত্রে কোন একজন বর্ণনাকারী না থাকা। 
  2. হাদীস বর্ণনাকারী সমালোচিত বা কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া।

(আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়াহ রহ. লিখিত; হাদীস অধ্যয়নের মূলনীতি – পৃ: ২০৬)

সনদের দুর্বলতার মাত্রার তারতম্যের কারণে হাদীসের হুকুমেও পরিবর্তন হয়ে থাকে।

পর্যায়ক্রমে দুর্বলতার আধিক্য হিসাবে হাদীসটিতে শায, মুআল্লাল, মাকলুব, যঈফ জিদ্দান, মুদরাজ, মাতরুক, মুনকার প্রভৃতি হুকুম প্রয়োগ হয়ে থাকে। 

আমরা এখানে এমন যঈফ হাদীস নিয়ে আলোচনা করব, যা একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে এবং যার বর্ণনাকারী মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত নয়। যঈফ হাদীস বললে সাধারণত এ ধরনের হাদীসই বোঝানো হয়। এমন যঈফ হাদীসই শর্তসাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য। আর  জাল হাদীস বা অত্যাধিক দুর্বল হাদীস কারো নিকটই আমলযোগ্য নয়। আল্লামা যফর আহমদ উসমানী রহ. এই ব্যাপারে বলেন,

ليس المراد بالضعيف ما كان شديد الضعيف، فإنه لا يعمل به أصلا

অর্থাৎ সাধারণ যঈফ হাদীস দ্বারা এমন হাদীস উদ্দেশ্য নয় যা সনদের বিচারে অত্যাধিক দুর্বল। কারণ এমন হাদীসের উপর কোনোভাবেই আমল করা সহীহ নয়  (ই’লাউস সুনান- ১৯/ ৯৭)।

আল্লামা যফর আহমদ উসমানী রহ. এর এই কথা দ্বারা বুঝা যায় যে, যঈফ হাদীস হলো এমন হাদীস যা সনদের ক্ষেত্রে অত্যাধিক দুর্বল নয়; যার সাথে জাল বা বানোয়াট বিষয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কারণ বানোয়াট ও অত্যাধিক যঈফ হাদীস কোনোভাবেই আমলযোগ্য নয়।

জাল হাদীস ও যঈফ হাদীস  কি এক?

বর্তমানে একশ্রেণির মানুষ জাল ও যঈফ হাদীসের মাঝে কোনো ধরনের পার্থক্য করেন না। তারা যঈফ হাদীসকে জাল ও বানোয়াট মনে করেন। মুহাদ্দিসগণের স্বীকৃত মতামতকে উপেক্ষা করে আহলে হাদীস ভাইয়েরাও যঈফ হাদীসের যথাযথ তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেন না। মূলত জাল হাদীস কোনো হাদীস নয়। এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেননি তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা বলে চালিয়ে দেওয়ার নামই জাল হাদীস। আল্লামা মাহমূদ আততাহহান রহ. জাল হাদীসের সংজ্ঞায় বলেন,

هو الكذب المختلق المصنوع المنسوب إلى رسول الله صلى الله عليه و سلم

যে মিথ্যা মনগড়া উপাখ্যান নিজের পক্ষ থেকে তৈরী করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে মওযূ’ বা জাল হাদীস বলে। (তাইসীরু মুসতালাহীল হাদীস, পৃ: ৮৯)    

অপরদিকে সাধারণ যঈফ হাদীস বলতে বানোয়াট হাদীসকে বোঝায় না, বরং হাদীসের সনদ বা সূত্রগত দুর্বলতা থাকলে সেটাকে সাধারণভাবে যঈফ হাদীস বলে।

হানাফি মাযহাবের বিখ্যাত কিতাব হেদায়ার ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইবনুল হুমাম রহ. বলেন,

والاستحباب يثبت بالضعيف غير الموضوع

অর্থাৎ কোনো মুস্তাহাব হুকুম সাব্যস্ত করার জন্য যঈফ হাদীস গ্রহণযোগ্য। তবে মওযু’ বা জাল হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।  (ফাতহুল কাদীর: ২/১৩৩)

ইবনুল হুমাম রহ. এর এই কথা দ্বারাও যঈফ ও জাল হাদীসের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়।

এতে বোঝা গেল, একটি হাদীস যঈফ হলেই সেটাকে জাল বা বানোয়াট মনে করা একজন হাদীসপ্রেমীর কাজ নয়। হাদীস সম্পর্কে অভিজ্ঞ কোনো সচেতন ব্যক্তি এমনটা করতে পারেন না। মুহাদ্দিসগণের মতে সাধারণ যঈফ হাদীস আর জাল হাদীসের জন্য রয়েছে আলাদা বিধান। উভয়ের মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক।

যঈফ হাদীসের হুকুম

অধিকাংশ ওলামা-ফোকাহা ও মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে কোনো যঈফ হাদীসের সনদ সামান্য  দুর্বল হলে সে হাদীসটি ফযীলতের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। তবে যঈফ হাদীস দ্বারা কোনো আহকাম বা আকিদা সংক্রান্ত বিষয়ে দলীল প্রদান করা সহীহ নয়। সর্বস্তরের ওলামায়ে কেরামের নিকট এটাই গ্রহণযোগ্য অভিমত।

চার মাযহাবের ইমামগণসহ বড় বড় হাদীস-বিশারদগণের কেউ-ই হাদীস যঈফ হলেই সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার প্রবক্তা নন। নিম্নে তাদের কিছু অভিমত পেশ করা হলো। (এখানে ওলামায়ে কেরামের এমন একটি জামাতের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে যাদেরকে বাদ দিলে ইলমে হাদীস ও ফিকহ-ই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একজন সত্য অনুসন্ধানী ব্যক্তির  সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।)

যঈফ হাদীসের ব্যাপারে চার মাযহাবের ইমামগণের অবস্থান

বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর মাঝে স্বীকৃত চার মাযহাবের ইমামগণের অবস্থান, যইফ হাদীসের ব্যাপারে কেমন ছিল? নিম্নে তা তুলে ধরা হলো।

যইফ হাদীসের ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা রহ. এর অবস্থান

ইমাম আবু হানিফা রহ. এর অবস্থান যঈফ হাদীসের ব্যাপারে একদম পরিস্কার। তার মতে যঈফ হাদীস শুধু আমলযোগ্যই না বরং তা কেয়াস থেকে উত্তম।

ইবনে হাযম রহ. ইমাম  আবু হানিফা রহ. এর অবস্থান সম্পর্কে বলেন,

جميع الحنفية مجمعون على أن مذهب أبي حنيفة أن ضعيف الحديث عنده أولى من الرأى

     (ملخص إبطال القياس- ص 68 )        

অর্থ: সকল হানাফি ওলামায়ে কেরাম একমত যে, ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মাজহাব হলো- যঈফ হাদীস কেয়াসের চেয়ে উত্তম।

যঈফ হাদীসের ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ী রহ. এর অবস্থান

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলেন, ইমাম শাফেয়ী রহ. এর নিকট যঈফ হাদীস কেয়াসের চেয়ে অগ্রগামী। (সূত্র: হাদীস আওর ফাহমে হাদীস- ৪৪৬)

আল্লামা সাখাভী রহ. বলেন, ইমাম শাফেয়ী রহ. এর নিকট মুরসাল হাদীস যঈফ। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে যদি মুরসাল হাদীস ছাড়া আর কোনো বর্ণনা পাওয়া না যায়  তাহলে তিনি সেটা দ্বারা দলীল দেওয়া জায়েয মনে করেন। ( ফাতহুল মুগীস: ১/২৭০ )

যঈফ হাদীসের ব্যাপারে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এর অবস্থান

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে,

إن ضعيف الحديث أحب أليه من رأي الرجال

অর্থ: যঈফ হাদীস ইমাম আহমদ রহ. এর নিকট মানুষের মতামত বা কেয়াসের চেয়ে উত্তম।  (সূত্র: ই’লাউস সুনান-১৯ / ৯৭) 

ইমাম সাখাভী রহ. ইমাম আহমদ রহ. এর ব্যাপারে বলেন,

لكنه احتج(أحمد) رحمه الله بالضعيف 

অর্থ: ইমাম আহমদ রহ. যঈফ হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেছেন।   ( সূত্র: ফাতহুল মুলহীম- ১ / ১৫২)

যঈফ হাদীসের ব্যাপারে ইমাম মালেক  রহ. এর অবস্থান

মালেকী মাযহাবের নির্ভযোগ্য কিতাব نشر البنود على مراقي السعود এ বর্ণিত আছে, ইমাম মালেক রহ. যঈফ হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করতেন। ( সূত্র: হাদীস আওর ফাহমে হাদীস: পৃ- ৪৪৬ )

বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত চার মাযহাবের ইমামগণের অবস্থান দ্বারা একথা আরো স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, যঈফ হাদীস কোনো ফেলনা জিনিস নয়। শর্তসাপেক্ষে যঈফ হাদীসের উপর আমল করা ওলামায়ে কেরামের স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য অভিমত

যঈফ হাদীসের ব্যাপারে ইমাম বুখারী রহ. এর অবস্থান

সহীহ হাদীস জপ করে করে যারা যঈফ সকল হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করতে চান, যাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হাদীস মানেই কেবল সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীস। তাদের জেনে রাখা উচিত- খোদ ইমাম বুখারী রহ. এর সহীহ বুখারীতে যদিও কোনো যঈফ হাদীস নেই, কিন্তু তিনি  তার সংকলিত কিতাব “আল আদাবুল মুফরাদ” এর মধ্যে  বেশ কয়েকটি  যঈফ হাদীস বর্ণনা করেছেন। আল্লামা শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. ‘ আল আদাবুল মুফরাদে’র বাইশটি হাদীসকে যঈফ সাব্যস্ত করেছেন। (সূত্র: হাদীস আওর ফাহমে হাদীস- পৃ: ৪৫২)

ইমাম বুখারী রহ. এর মতো বিদগ্ধ মুহাদ্দিস বাইশটি হাদীস অসচেতন ও উদাসীনভাবে বর্ণনা করেছেন এমনটি ভাবা বোকামি বৈ কিছু নয়। মূলত কিতাবটি আমলের ফাজায়েল সংশ্লিষ্ট হওয়ায় সজ্ঞানে তিনি তা বর্ণনা করেছেন- এটা সর্বজনবিদিত। এতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, ইমাম বুখারী রহ.এর মতেও ফাজায়েলে আমলের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস গ্রহণযোগ্য। অন্যথায় কখনোই তিনি যঈফ হাদীস বর্ণনা করে ইলমী খেয়ানত করতেন না।

যঈফ হাদীসের ব্যাপারে পরবর্তী কালের কয়েকজন বিদগ্ধ ইমামের বক্তব্য

আল্লামা ইমাম নববী রহ. ফযীলতের ব্যাপারে যঈফ হাদীস গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের ইজমা তথা ঐকমত্যের দাবি করে বলেন,

أجمع أهل الحديث و غيرهم على العمل في الفضائل… بالحديث الضعيف  

অর্থ: মুহাদ্দিসগণ  আমলের ফজীলতের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীসের উপর আমল করার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। (সূত্র: হাদীস আওর ফাহমে হাদীস- পৃ: ৪৫০)

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)ও আমলের ফজীলতের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে ওলামায়ে কেরামের ইজমা হয়েছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেন- 

قد اتفق العلماء على جواز العمل بالحديث الضعيف في فضائل الأعمال. (الأجوبة الفاضلة – ص 42 ) 

অর্থ: ওলামায়ে কেরাম আমলের ফজীলতের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীসের উপর আমল জায়েয বলে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।

আল্লামা ইবনে মাহদী রহ. বলেন,

إذا روينا عن النبي صلى الله عليه و سلم في الحلال و الحرام و الأحكام شددنا في الأسانيد وانتقدنا في الرجال  وإذا روينا في الفضائل و الثواب و العقاب سهلنا في الأسانيد و تسامحنا في الرجال.  (الأجوبة الفاضلة – ص 50 )

অর্থ: যখন আমাদের নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হালাল-হারাম এবং আহকামের বিষয়ে কোনো হাদীস বর্ণনা করা হয়, তখন আমরা হাদীসের সনদ ও বর্ণনাকারীকে কঠোরভাবে যাচাই করি। আর যখন আমাদের নিকট ফাজায়েল, সওয়াব ও শাস্তির ব্যাপারে কোনো হাদীস বর্ণনা করা হয় তখন আমরা হাদীসের বর্ণনাকারী ও সনদকে শিথিল দৃষ্টিতে দেখি।

আল্লামা ইবনে মাহদীর এই উক্তি দ্বারা অকাট্যভাবে একথা প্রমাণিত হয় যে, হালাল-হারাম ও আহকামের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস গ্রহণযোগ্য না হলেও সওয়াব ও ফাজায়েলের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস গ্রহণ করা জায়েয এবং মুহাদ্দিসগণের রীতি এমনই।

ইমাম যাহাবী রহ. বলেন,

ينبغي التثبت في الأحاديث الضعيفة ، فلا يبالغ الشخص في ردها مطلقا و لا في استعمالها و الأخذ بها مطلقا، بخلاف الأحاديث الساقطة و الموضوعة فلا يجوز العمل بها أصلا

অর্থ: যঈফ হাদীসের ব্যাপারে চিন্তা-ফিকির করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কেউ যেন যঈফ হাদীসকে ঢালাওভাবে প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে অতিরঞ্জন না করে এবং তার উপর আমল করা ও তা শর্তহীনভাবে গ্রহণ করার ব্যাপারেও বাড়াবাড়ি না করে। এর বিপরীত হলো, জাল হাদীস। কারণ,জাল হাদীসের উপর কোনোভাবেই আমল করা জায়েয নয়। (সূত্র: মুহাযারাতু উলূমিল হাদীস – পৃ: ১৭০)

ইমাম যাহাবী রহ. এর এ কথা দ্বারা জাল হাদীস এবং যঈফ হাদীসের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পাশাপাশি যঈফ হাদীসের ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বনের বার্তা পাওয়া যায়।

হানাফি মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব আদদুররুল মুখতারের লেখক আল্লামা আলাউদ্দিন হাসকাফী রহ. যঈফ হাদীসের আমলের ব্যাপারে বলেন,

فيعمل به في فضائل الأعمال (الدر المختار – 1/87 )

অর্থ: আমলের ফজীলতের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীসের উপর আমল জায়েয।

আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহ. এই উক্তিকে সমর্থন করে এর ব্যাখ্যায় লেখেন-

لأجل تحصيل الفضيلة المترتبة على الأعمال

অর্থাৎ যঈফ হাদীসের উপর ফাজায়েলের ক্ষেত্রে আমল জায়েজ হওয়ার কারণ হলো, এতে সওয়াব পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল মালেক দা.বা. শায়খ আলবানী রহ. এর ব্যাপারে বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলেন,

“যয়ীফ হাদীস কোনো ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য নয়” – এই মত যা শায়খ আলবানী অবলম্বন করেছেন, সলফ-খলফের ( পূর্ববতী ও পরবর্তীদের ) কেউ তা পোষণ করতেন না। তাঁর এ মতটি ইমাম বুখারী রহ., তাঁর মাশায়েখ, সমসাময়িক ইমাম ও শিষ্যবৃন্দের এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল ইমামের মতের সম্পূর্ণ বিরোধী। পূর্ববর্তী ইমামগণের ইজমায়ী মতকে দলীলহীন বা দলীল পরিপন্থী বলা শুধু যে অন্যায় দুঃসাহসিকতা প্রদর্শন তাই নয়, তা শাস্ত্রীয় জ্ঞানের অপ্রতুলতারও একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।

(নির্বাচিত প্রবন্ধ- ১/২৫৪)

যঈফ হাদীসের উপর আমল করার শর্তাবলি

আল্লামা সাাখাভী রহ. তার কিতাব القول البديع এর মধ্যে ইবনে হাজার রহ. থেকে বর্ণনা করে বলেন, যঈফ হাদীসের উপর আমল করার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছেঃ

১) যঈফ হাদীসটি অত্যাধিক দুর্বল না হওয়া। তাই যে হাদিস কেবল এমন কেউ বর্ণনা করেন যিনি চরম মিথ্যুক কিংবা মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত অথবা যার ভুলের পরিমাণ অনেক বেশি।

২)  বর্ণিত হাদীসটি শরীয়তের কোনো মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত হ‌ওয়া। তাই যে য‌ঈফ হাদীসের বিষয় সম্পূর্ণ নতুন, যা কোন মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত নয়, সে হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।

৩) উক্ত হাদীসটির উপর আমল করার সময় হাদীসটি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত এমন দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে না, (বরং এর ফযীলত হাসিলের উদ্দেশ্যই আমল করবে,) যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেননি তা তাঁর দিকে সম্বন্ধযুক্ত করা আবশ্যক না হয়। ( আল কাউলূল বাদী’ : ১৫৯ )

আল্লামা আব্দুল হাই লাখনোভী রহ. চতুর্থ আরেকটি শর্ত যোগ করেছেন। তা হলো :

 ৪) যঈফ হাদীসে বর্ণিত সংশ্লিষ্ট বিষয়টি  কোনো শক্তিশালী দলীলের সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া । এমনটি হলে যঈফ হাদীসের উপর আমল না করে উক্ত শক্তিশালী দলীলের উপর আমল করতে হবে। (সূত্র: হাদীস আওর ফাহমে হাদীস: পৃ-৪৬৩ ) 

যইফ হাদীস নিয়ে একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর

প্রশ্ন: বর্তমান সময়ে আহলে হাদীস ভাইয়েরা সহ অনেকের কাছেই জাল ও যঈফ হাদীস একই। তারা প্রায়ই প্রশ্ন করে থাকেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাজার হাজার সহীহ হাদীস থাকতে কেন যঈফ হাদীস নিয়ে এমন উঠে পড়ে লাগতে হবে? যঈফ হাদীস আমলযোগ্য প্রমাণে এমন ব্যর্থ চেষ্টা করে কেন মানুষকে সহীহ হাদীস থেকে দূরে রাখতে হবে? বহু সহীহ হাদীসই তো মানুষ  আমল করে না, সেখানে যঈফ হাদীস নিয়ে কেন এমন যুক্তি-তর্ক? 

উত্তর: ওলামায়ে কেরাম সব ধরণের যঈফ হাদীসকে আমলযোগ্য সাব্যস্ত করেননি। সনদের বিচারে তুলনামূলক কম দুর্বল হাদীসগুলোকেই কেবল আমলযোগ্য সাব্যস্ত করেছেন, সেটাও শর্তসাপেক্ষে। এর দ্বারা মানুষকে সহীহ হাদীস থেকে দূরে রাখা উদ্দেশ্য নয়। বরং আল্লাহর রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো হাদীস যেন মানুষের আমল থেকে ছুটে না যায় সেটাই উদ্দেশ্য।

ওলামায়ে কেরাম এক্ষেত্রে ঢালাওভাবে সবক্ষেত্রে যঈফ হাদীসকে প্রমোট করেননি। আমলের ফজীলতের ব্যাপারে যঈফ হাদীসকে আমলযোগ্য সাব্যস্ত করেছেন। আহকাম বা ইসলামী বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে নয়। মানুষ যেন আমলের ফজীলতের ক্ষেত্রে সেগুলোর উপর আমল করে দুনিয়া-আখেরাতের প্রভূত কল্যাণ অর্জন করতে পারে ওলামায়ে কেরাম সেদিকে লক্ষ রেখেছেন। অপরদিকে বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে সতর্কতাবশতঃ যঈফ হাদীসের উপর আমল করতে নিষেধ করেছেন।  

আর বর্তমান সময়ে অনেক সহীহ হাদীসের উপরও মানুষ আমল করে না – এমন ঠুনকো যুক্তি দিয়ে ওলামায়ে কেরামের এমন বিশাল একটি জামাতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়। বর্তমান সময়ে মানুষ তো ফরয বিধানও যথাযথভাবে আদায় করে না, এই যুক্তি দেখিয়ে কি আমরা সুন্নত ও নফল আমল ছেড়ে দিতে পারি?

বস্তুতঃ গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, শর্ত মেনে যঈফ হাদীসের উপর আমল করাই অধিক যুক্তিযুক্ত ও মধ্যপন্থী অবস্থান। এতে হাদীস অবমাননা নয় বরং হাদীসের উপর যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয়।  এর মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব হাদীসের উপর আমল করার এক ঐশ্বরিক ইশক-মুহাব্বত লাভ হয়। এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব হাদীসকে একবাক্যে ছুঁড়েও ফেলে দেয়া হয়না, আবার বাছ-বিচার না করে সব হাদীসকে আমলযোগ্যও সাব্যস্ত করা হয়না।

যঈফ হাদীস নিয়ে চরমপন্থা নয়; মধ্যপন্থী অবস্থানই কাম্য

পুরো প্রবন্ধজুড়ে একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, উম্মাহর প্রায় সিংহভাগ ওলামায়ে কেরাম যঈফ হাদীস বিষয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তারা যঈফ ও জাল হাদীসের মাঝে পার্থক্য করেন। একবাক্যে যঈফ হাদীসকে অগ্রহণযোগ্য বলেন না

আফসোসের বিষয় হলো, আহলে হাদীস নামধারী একশ্রেণীর মানুষ ইতিহাসের বরেণ্য ইমাম ও মুহাদ্দিসগণের স্বীকৃত সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে কেবল নাসীরুদ্দীন আলবানী রহ. এর অভিমতকে সহীহ মনে করেন। যাদের হাতধরে ইলমে হাদীস ও ফিকহ আমাদের কাছে এসেছে তাদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে কেবল দু-একজন সমকালীন স্কলারকে গ্রহণ করা কখনোই ইনসাফপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে না।

শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রহ. যঈফ হাদীসকে জাল বা মাওযু হাদীসের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। অথচ পূর্বসূরি ইমামগণের উদ্ধৃতিতে আমরা এ কথা প্রমাণ করে এসেছি যে, জাল আর যঈফ এক নয়। জাল হাদীসকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস বলার সুযোগ নেই। এর বিপরীতে যঈফ হাদীসকে হাদীস হিসেবে অস্বীকারের সুযোগ নেই। শর্তসাপেক্ষে এ হাদীস আমলযোগ্য।

যঈফ হাদীসকে যাচাই-বাছাই না করে জাল বলে দেয়া কিংবা জাল হাদীসের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা উম্মাহর স্বীকৃত অভিমতকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শনের নামান্তর। সমসাময়িক দু-একজন স্কলারের অভিমতকে পুঁজি করে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল হক্বানী আলেমকে ভ্রান্ত বলে চিহ্নিত করা কোনো সচেতন মুসলিমের কাজ নয়। তাই যঈফ হাদীস নিয়ে কঠোরতা নয়, চাই মধ্যপন্থা। প্রয়োজন সত্যানুসন্ধানী আহলে ইলমের দীর্ঘ ও নূরানী সাহচর্য।


লেখাটি রিভিউ ও সম্পাদনা করেছেন মুসলিমস ডে অ্যাপের শরয়ী সম্পাদক মাওলানা শিব্বীর আহমদ। উসতাযুল হাদীস, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া ঢাকা, মোহাম্মদপুর।

Comments
  1. আসসালামু আলাইকুম ওয়ারহমাতুল্লাহ ভাই।
    আল্লাহ আপনাদের উত্তম প্রতিদান দিন। যঈফ হাদীস আমলযোগ্য হওয়ার বিষয়টি পরিস্কার।
    কিন্তু শর্ততে যে বলা হয়েছে যদি যঈফ হাদিসের বিপরীতে সহীহ হাদিস থাকলে তা আমলযোগ্য নয়, এবং আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান অনুযায়ী ইমাম আবু হানিফা র: ও সহীহ হাদিসকেই মাসয়ালার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতেন।
    সেই অনুযায়ী আমাদের হানাফি ভাইদেরও কি উচিত নয় যে সলাতের রফলে ইয়াদায়িনের মত সুস্পষ্ট সহীহ হাদিসগুলোকে গ্রহণ করে নেওয়া। এক্ষেত্রে তাদের সহীহ হাদিসের পরিবর্তে দুর্বল বা যঈফ হাদিসের উপর আমল করা কি মধ্যমপন্থার পরিপন্থি নয়!
    বিষয়টি জানিয়ে উপকৃত করবেন ভাই।
    মা আস সালাম

    1. ওয়াআলাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ
      জী ভাই, যঈফ হাদীসের বিপরীতে যদি সহীহ হাদীস থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে সহীহ হাদীসের ওপরই আমল করতে হয়। এটাই স্বাভাবিক কর্মপন্থা। কিন্তু আপনি যে মাসআলার কথা উল্লেখ করেছেন, তাতে তো হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ যঈফ হাদীসের ওপর আমল করেন না, বরং তাদের আমল এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে সহীহ হাদীস নির্ভর। সংক্ষেপে বলি, রুকুতে যাওয়া ও রুকু থেকে ওঠার সময় রফয়ে ইয়াদাইন না করা কেবল ইমাম আবু হানীফা রহ.এরই বক্তব্য নয়, ইমাম মালেক রহ.ও বলেছেন, তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া অন্য কোনো তাকবীরের সময় হাত তোলার নিয়ম আমার জানা নেই। আর ইমাম মালেক রহ. যেহেতু মদীনা মুনাওয়ারার বড় মুহাদ্দিস ও ফকীহ ছিলেন, তাই তার বক্তব্য থেকে মদীনাবাসী সাহাবী-তাবেয়ীদের আমল সম্পর্কে একটা মজবুত ধারণা পাওয়া যায়।

      দ্বিতীয়ত, ইমাম আবু হানীফা রহ. কুফার মানুষ ছিলেন। আর কুফা ছিল তৎকালে অন্যতম ইলমি শহর। এ শহরে প্রায় দেড় হাজার সাহাবী অবস্থান করতেন। তাদের মধ্যে প্রায় পাঁচশ জন স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করতেন। তাই কুফা নগরীর বাসিন্দা যারা ছিলেন, তারা এ শত-সহস্র সাহাবী থেকেই তাদের দীন শিখেছেন। আর এ কুফাবাসী তাবেঈ-তাবে তাবেঈদের সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তারা কেউ নামাজে তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া অন্য কোনো সময় হাত তুলতেন না। স্বাভাবিক কথা, কুফাতে যে পনের শত সাহাবী থাকতেন, তাদের কেউ যদি রুকুতে যাওয়া ও রুকু থেকে ওঠার সময় রফয়ে ইয়াদাইন করতেন, তাহলে তাদের ছাত্রদের কেউ না কেউ অবশ্যই এর ওপর আমল করতেন; তারা সম্মিলিতভাবে এ আমলটি ছেড়ে দিতেন না।

      তৃতীয়ত, প্রসিদ্ধ সাহাবীদের মধ্যে যারা নামাজের ভেতরে রফয়ে ইয়াদাইন করতেন না কিংবা যারা রফয়ে ইয়াদাইন না করার হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হযরত উমর ফারুক রা., হযরত আলী রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., হযরত বারা ইবনে আযিব রা. প্রমুখ। এমনকি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা., যিনি রফয়ে ইয়াদাইন করার হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তার বর্ণিত সে হাদীস বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, তিনি নিজে রফয়ে ইয়াদাইন করতেন না। [মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা এবং শারহু মাআনিল আছার গ্রন্থে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।]

      চতুর্থত, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. রুকুতে যাওয়া ও রুকু থেকে ওঠার সময় রফয়ে ইয়াদাইনের হাদীস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তার থেকে সহীহ ও গ্রহণযোগ্য সূত্রেই আরও বিভিন্ন জায়গায় রফয়ে ইয়াদাইনের কথা বর্ণিত হয়েছে। খোদ সহীহ বুখারীতেই তার সূত্রে রুকুর আগে-পরে এবং দুই রাকাত শেষে দাড়ানোর সময় রফয়ে ইয়াদাইনের হাদীস বর্ণিত আছে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৩৯] আবার তাকবীরে তাহরীমার বাইরে শুধু রূকু থেকে ওঠার সময়ও হাত তোলার কথা তিনি বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী রহ. তদীয় ‘জুযউ রফইল ইয়াদাইন’ পুস্তিকায় ইবনে উমর রা.এর সূত্রে মোট পাঁচ জায়গায় রফয়ে ইয়াদাইনের হাদীস বর্ণনা করেছেন- তাকবীরে তাহরীমার সময়, রুকুতে যাওয়া ও রুকু থেকে ওঠার সময়, দুই রাকাত শেষে দাড়ানোর সময় এবং সেজদায় যাওয়ার সময়। এমনকি প্রত্যেক ওঠানামার সময়ও সহীহ সূত্রে তার থেকে রফয়ে ইয়াদাইনের কথা বর্ণিত আছে। যেহেতু সবগুলোই সহীহ হাদীস তাই রফয়ে ইয়াদাইন করলে তো সবগুলোর ওপরই আমল করার কথা। কিন্তু যারা রফয়ে ইয়াদাইন করেন, তারা তো কেবল রুকুর আগে-পরে হাত তোলার কথাই বলে থাকেন। এ ক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবের কথা হলো, রফয়ে ইয়াদাইন ধীরে ধীরে কমে গেছে। এবং এ হিসেবে শুধু তাকবীরে তাহরীমার সময় রফয়ে ইয়াদাইনই ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ আমল।

      পঞ্চমত, শুধু তাকবীরে তাহরীমাতেই হাত তোলা এবং নামাজের ভেতর অন্য কোথাও হাত না তোলার বিষয়টি একাধিক সহীহ হাদীসেই বর্ণিত হয়েছে। জামে তিরমিযীর ২৫৭ ও সুনানে আবু দাউদের ৭৪৮ নং হাদীস- এ হাদীসে বর্ণিত আছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল হিসেবে একবার মাত্র হাত তুলে দেখিয়েছেন। এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযীর দৃষ্টিতে হাসান, ইবনে হাযাম যাহেরি রহ.এর মতে সহীহ। তিরমিযী শরীফের টীকায় শায়খ আহমাদ শাকেরও একে সহীহ বলেছেন।

      এরপরও কি সত্যসন্ধানী বিবেকবান কেউ এ আপত্তি করতে পারেন- হানাফী মাযহাবের রফয়ে ইয়াদাইন না করার আমলটি দলিলহীন কিংবা দুর্বল হাদীস নির্ভর!!

  2. সকাল সন্ধ্যা সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়ার হুকুম কি?

    1. এ সংক্রান্ত হাদীসটি যঈফ। তবে ফাযায়েলের ক্ষেত্রে এতটুকু দুর্বলতা সত্ত্বেও আমল করা যায়। তাই তা আমল করতে কোনো অসুবিধা নেই। হাদীসটি এমন : হযরত মা‘কিল ইবনে ইয়াসার রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেউ যদি সকাল বেলা তিনবার ‘আউযুবিল্লাহিস সামীইল আলীমি মিনাশ শায়তানির রাজীম’ পড়ে সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পাঠ করে, তবে তার জন্যে সত্তর হাজার ফেরেশতা নিয়োজিত করা হয়, তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্যে দুআ করতে থাকে আর সেদিন যদি সে মারা যায় তবে সে শহীদ হবে। আর যে সন্ধ্যায় পড়বে তার জন্যেও অনুরূপ মর্যাদা রয়েছে। [জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯২২, ইমাম তিরমিযীর মতে, হাদীসটি ‘হাসান গরীব’ কিংবা ‘গরীব’।]

  3. মা শা আল্লাহ, আল্লাহ তায়ালা উস্তাদের ইলমে বারাকাহ দান করুক, আমিন।

  4. Alhamdulillah

  5. মাশা আল্লাহ,,, আলহামদুলিল্লাহ।

  6. Jazakallohu Khoiron.

  7. মাযহাব মানা যায় কি?না মানলে কোনো ধরনের গুনাহ হবে কি? আল্লাহ আর রাছুল এবং কোরান এবং হাদিস মানলে তা কি পরিপূর্ণ নয়?

    1. মাযহাব মানা তো জরুরি। কুরআন ও হাদীসের সহীহ অনুসরনের জন্যেই মাযহাব মানতে হয়। হ্যাঁ, যদি কেউ মুজতাহিদ হয়ে থাকেন, কিংবা কুরআন-হাদীস নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে সকল মাসআলায় নিজে নিজে সমাধান করতে পারেন, তার জন্যে মাযহাব মানা জরুরি নয়। কিন্তু যারা এমন নয়, তাদের জন্যে মাযহাব মানা জরুরি।

      আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা হলো, যারা কুরআন-হাদীসের ভাসা ভাসা জ্ঞান রাখে, যে কোনো সংকটে পড়লে তারা নিজেরা সমাধান করতে পারে না এবং তাদের ঘরানার অন্য কোনো শায়খের শরণাপন্ন হয়, হাদীসের ব্যাখ্যা ও মান যাচাই যাদের কাছে এক দূরুহ কাজ, এমনকি যারা দেখে দেখে আরবি হাদীস পড়তেও পারে না, বাংলা অনুবাদ দেখে যারা হাদীস বুঝে থাকে, তারা দাবি করে- কুরআন-হাদীস থাকতে মাযহাব মানব কেন?

      বাস্তবতা হলো, মাযহাব তো তারাও মানে। তারা কেউ হয়তো শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রহ.এর মাযহাব মানে, কেউ শায়খ বিন বায রহ.এরে মাযহাব মানে, কেউ মতিউর রহমান মাদানীর মাযহাব মানে, কেউ অন্য কারও মাযহাব মানে।

      মাযহাব অর্থ পথ। কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা মানতে গিয়ে যে যার কথা অনুসরন করে সে তার মাযহাবই অনুসরণ করে। এটাই বাস্তবতা। তারা হাজার বছর ধরে গোটা মুসলিম বিশ্বে স্বীকৃত চার মাযহাবের কোনো একটি মাযহাব অনুসরণকে অস্বীকার করে ঠিক, কিন্তু নিজেরা আবার বর্তমান কালের কোনো শায়খের মাযহাব মেনে থাকে। কথা হলো, মানতেই যদি হয়, তাহলে যারা জ্ঞানে-গুণে শতগুণ শ্রেষ্ঠ ছিলেন, ইলম ও তাকওয়ার অনেক উচ্চ আসনে অধীষ্ঠিত ছিলেন, তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের কেন মানব?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

সাম্প্রতিক পোস্ট সমূহ
ক্যাটাগরি সমূহ
ট্যাগ সমূহ
error: অনুগ্রহ করে লেখাটি কপি করবেন না। লিংক শেয়ার করুন। ধন্যবাদ