Post Updated at 6 Apr, 2024 – 9:55 AM

কুরআন হাদীসের যেখানে “রিবা” শব্দটি ব্যবহৃত হয় আমরা এর সরল অনুবাদ করি “সুদ“। আর সুদ অনুবাদ করার পরেই আমাদের মাথায় কাজ করে ঋণ দিয়ে সেখান থেকে সুবিধা নেয়া বা বাড়তি টাকা নেয়া। এছাড়া আর অন্য কোনো কিছুতে যে সুদ বা রিবা থাকতে পারে সেটা আমরা বেশির ভাগ মানুষই জানি না। “রিবা” শব্দের অনুবাদ তাই “সুদ” না করে “রিবা” পরিভাষাটিই ব্যবহার করা শ্রেয়। যেন রিবা’র ব্যাপ্তি কমে না যায়।

ইসলামী অর্থনীতিতে রিবা শব্দটি কেবল মহাজন বা ব্যাংকের সুদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং রিবা বিষয়টি আরো অনেক বিস্তৃত। ইসলামী পরিভাষায় রিবাকে বলতে পারি এক গুচ্ছ লেনদেনের সেট। যার মাঝে সুদ একটি উপাদান। কিন্তু রিবা বলতে কেবল সুদকেই বুঝায় না। সুদের বাইরের অনেক লেনদেনকেই ইসলাম রিবা হিসাবে চিহ্নিত করে। আমরা জানি আজকের এই পোস্টের পরে অনেকেই ধাক্কা খাবেন। অনেকেই আমাদেরকে ডিফেন্ড করতে আসবেন। বিভিন্ন যুক্তিতর্ক দিয়ে এ পোস্টের বিষয়বস্তুকে ভুল প্রমাণের ক্ষেত্রেও অগ্রগামী হবেন কেউ কেউ। যেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর, তাই আগে থেকে একটু heads-up দিয়ে রাখলাম। আপনি আমার ভাই! আপনাকে রিবার বিষয়ে সতর্ক করা আমার দায়িত্ব! আমাদেরকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ! পোস্টটি লিখা হচ্ছে হানাফী ফিকহের আলোকে। অন্য মাযহাবে ভিন্ন মত থাকতে পারে। তাই আপনার আস্থাভাজন কোনো আলেমের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে নিতে পারেন। যিনি ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে এক্সপার্ট।

 

নতুন টাকা কেনা-বেচা করা অভিশপ্ত রিবা’র অন্তর্ভুক্ত

ঢাকার গুলিস্তান সহ বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় ঝুড়িতে করে নতুন টাকার বান্ডিল নিয়ে বিক্রেতাগণ বসে থাকেন। ঈদের সময় জমজমাট হয়ে ওঠে নতুন টাকার এই বাজার। যেখানে ১০ টাকার নোট দিয়ে ১০০০ টাকা মূল্যমানের চকচকে নতুন টাকা কিনতে হয় ১২০০ টাকায় (দাম কম-বেশি হতে পারে)। অর্থাৎ আমি ১০০০ টাকার মূল্যমানের নোটই পাব। কিন্তু ২০০ টাকা বেশি প্রদান করতে হবে। উক্ত লেনদেনটি ইসলামী অর্থনীতিতে “রিবা” হিসাবে গণ্য হবে।

আরেকটি ইউজ কেস দেখা যায় বাসের স্টাফদের মাঝে। তাদের ভাংতি টাকার দরকার হয়। সে সময় তারা ১০০ টাকা দিল বিক্রেতাকে। বিক্রেতা ফেরত দিল ৯৫ টাকা। যা ৯টি ১০ টাকার নোট ও ১ টি ৫ টাকার নোটের সমন্বয়। অর্থাৎ ১০০ টাকা ভাংতি করার জন্য ৫ টাকা বাট্টা দিতে হলো।

ইসলামী অর্থনীতিতে উভয়টিই রিবা এর অন্তর্ভুক্ত। এই দুটি লেনদেনকে যদি আমরা “সুদ” বলে অভিহিত করি। তাহলে আমরা মিলাতে পারব না। পাল্টা প্রশ্ন আসবেই এটা আবার সুদ হলো কী ভাবে? প্রচলিত অর্থনীতির সুদের সংজ্ঞার সাথে এর তো কোনো মিল নাই। এজন্যই লেখার শুরুতে বলে নিয়েছি রিবা শব্দের অনুবাদ সুদ করা হলে এর সঠিক অর্থ প্রকাশ পায় না। তাই রিবাকে আমরা “রিবা”-ই বলবো। প্রচলিত অর্থনীতিতে নতুন টাকা কেনাকে সুদ বলা না হলেও, ইসলামী অর্থনীতিতে উক্ত লেনদেনকে “রিবা” এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

নতুন টাকা কেনা রিবা: হাদীসের দলিল

বেশ কয়েকটি হাদীসের দ্বারা উপরের বিষয়টিকে আলেমগণ রিবা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তন্মধ্য থেকে দুটি হাদীস নিচে তুলে ধরা হলো।

হাদীস ১

الذَّهَبُ بِالذَّهَبِ وَالْفِضَّةُ بِالْفِضَّةِ وَالْبُرُّ بِالْبُرِّ وَالشَّعِيرُ بِالشَّعِيرِ وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ مِثْلاً بِمِثْلٍ يَدًا بِيَدٍ فَمَنْ زَادَ أَوِ اسْتَزَادَ فَقَدْ أَرْبَى الآخِذُ وَالْمُعْطِي فِيهِ سَوَاءٌ

অর্থ: স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, বৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর ও লবনের বিনিময়ে লবন সমান সমান ও নগদ নগদ হতে হবে। এরপর কেউ যদি তা প্রদান করে বা গ্রহণ করে তবে তা সুদে পরিণত হবে গ্রহণকারী ও প্রদানকারী এতে সমপর্যায়ভূক্ত হবে।

(সহীহ মুসলিম, ৩৯১৯, باب الرِّبَا – লিংক)

হাদীস ২

 لاَ تَبِيعُوا الدِّينَارَ بِالدِّينَارَيْنِ وَلاَ الدِّرْهَمَ بِالدِّرْهَمَيْنِ

অর্থ: তোমরা এক দীনারকে দুই দীনারের বিনিময়ে এবং এক দিরহামকে দুই দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করো না।

(সহীহ মুসলিম, ৩৯১৩, باب الرِّبَا – লিংক)

উপরের হাদীস দুটির মত আরো অনেক হাদীস রয়েছে। যেগুলো দ্বারা বুঝা যায় সমজাতীয় বস্তুর মাঝে লেনদেন করার সময় কম-বেশি করে লেনদেন করলে সেটি রিবা হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কুরআন-হাদীস থেকে মাসআলা বা ফতোয়া বের করা অভিজ্ঞ আলেমদের কাজ। আরবি ভাষা ও দ্বীনের সম্যক জ্ঞান ব্যতিরেকে কোনো একটি হাদীসের অনুবাদ পড়ে সেটি থেকে মাসআলা বের করা বা ফতোয়া দেয়া ভুলের দরজা খুলে দেয়। একটি আয়াত বা হাদীসকে বুঝতে হয় নবীজি সা. ও তাঁর সাহাবীগণ সেই আয়াত বা হাদীসকে যেভাবে বুঝেছিলেন। সেই জ্ঞান ব্যতিত কেবল অনুবাদ পড়ে সকল দলিল সকলের বুঝে আসবে না এটাই স্বাভাবিক। তাই নিচের হাদীসগুলোর সাথে নতুন টাকা ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়কে আপনি রিলেট নাও করে থাকতে পারেন। আশা করি এজন্য হাদীসের অসম্মানজনক কোনো কথা আপনি বলবেন না।

ঈদের সালামী হিসাবে নতুন টাকা দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের করণীয়

ঈদের সময় সহ অন্যান্য সময় আমরা সালামী দেয়ার জন্য যারা এই লেনদেনটি করে থাকি। আল্লাহর ওয়াস্তে এর থেকে বিরত থাকুন। সম্ভব হলে সরাসরি ব্যাংক থেকে নতুন টাকা সংগ্রহ করুন। যেখানে আপনাকে বেশি অর্থ প্রদান করতে হবে না। সেটা সম্ভব না হলে শুধুমাত্র মনের প্রশান্তির জন্য আর বাচ্চাদের খুশির জন্য একটি হারাম কাজে জড়াবেন না। রিবার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন।

অনেকেই এই হারাম কাজটিকে বিভিন্ন ভাবে জায়েজ হিসাবে দাবী চেষ্টা করেন। এর মধ্যে কমন একটা প্রচেষ্টা হলো “যারা নতুন টাকা বিক্রি করেন, তারা কষ্ট করে সেগুলো সংগ্রহ করেন। তাই সার্ভিস চার্জ হিসাবে তারা অতিরিক্ত গ্রহন করতেই পারে। এটা রিবা হবে কেন?”

এর উত্তর হলো: হাদীসের ভাষ্য থেকে এটা স্পষ্টই রিবা। কষ্ট করলেই সকল কাজ হালাল হয়ে যায় না। কেউ কষ্ট করে মদ বা মাদক সংগ্রহ করে বিক্রি করলেও তা বৈধ হয়ে যায় না। বৈধ হওয়ার জন্য যে শর্তগুলো থাকা দরকার সেগুলো থাকতে হয়। আর অবৈধ হওয়ার জন্য যে বিষয়গুলো থাকা যাবে না, সেগুলোর অনুপস্থিতিও যে কোনো লেনদেনকে বৈধ করার জন্য জরুরি। তাই হারাম কাজে পরিশ্রম করলেই সেটি হালাল হয়ে যায় না।

বিভিন্ন দেশের কারেন্সি লেনদেনে কম-বেশি করা রিবা নয়

একই দেশের মুদ্রার এই মাসআলাটি ভিন্ন দেশের কারেন্সি কনভার্শনের ক্ষেত্রে এক নয়। ভিন্ন দেশের মুদ্রার মধ্যে কমবেশি করে লেনদেন করা জায়েজ। যেমন ১০০ টাকার বিনিময়ে ১ ডলার কিনলাম। এটা রিবার অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ ভিন্ন দেশের কারেন্সি সমজাতীয় হিসাবে গণ্য করা হয় না। তাই ভিন্ন কারেন্সির লেনদেনে কম বেশি করা যাবে। যেমন স্বর্ণ ও রূপার মধ্যে বিনিময়ের ক্ষেত্রে পরিমানের কম-বেশি হবে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে অভিশপ্ত রিবা’র যাবতীয় লেনদেন থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

আরো জানতে ভিজিট করুন:

Comments
  1. বিকাশে লেনদেন করার সময় অতিরিক্ত অর্থ নেই। এবং সেটা উঠাতে খরচ হয় এবং কিছু টাকা অবশিষ্ট থাকে। সেই টাকা কি রিবা হবে,,, জানালে উপকৃত হতাম,,,

    1. বিকাশের সার্ভিস চার্জটি আমাদের জানা মতে রিবা হিসাবে গণ্য হবে না।

  2. আসসালামু আলাইকুম ওরাহমাতুল্লাহ, হযরত অনেক সময় দেখা যায় যে টাকা ছিড়ে গেলে বা পুড়ে গেলে সে টাকা গুলিস্তানে বিক্রি করে ভালো টাকা নেয়া হয় উদাহরণস্বরূপ, আমার ১০০০ টাকার নোট কিছু অংশ পড়ে গিয়েছে, আমি সেটা গুলিস্তানে গিয়ে বিক্রি করে ৫০০ টাকা নিলাম, এটা কি জায়েজ?

    1. ওয়াআলাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ।
      ছেড়া বা পুড়ে যাওয়া টাকা কম মূল্যে বিক্রি করা যাবে না। তবে ছেড়া-ফাটা বা পোড়া টাকা ঠিক করা কিংবা তা ব্যাংক থেকে পাল্টিয়ে আনার জন্যে পারিশ্রমিক হিসেবে সামান্য কিছু কম নেয়া যেতে পারে।

  3. এই পোস্টটি পড়ার পর অনেক কিছু জানতে পারলাম। যদিও আমি মাদ্রাসার (আলিয়া) ছাত্র ছিলাম, তবুও আমি এভাবে কখনো “রিবা”-কে সংজ্ঞায়িত করতে শিখিনি। প্রত্যেক মুসলিম ব্যবসায়ীদের এই পোস্টটি অবশ্যই পড়া উচিত।
    জাযাকাল্লাহ খাইরান! (To Muslim Day Team)

  4. Rights

  5. আমরা যখন রেমিটেন্স পাঠাই তখন তো ওরা কিছু সার্ভিস চার্জ কেটে নেয় যার ফলে অনেক কম টাকা পাওয়া যায়। এটা কি রিবার অন্তর্ভুক্ত হবে?

    1. আমাদের জানা মতে এই সার্ভিস চার্জ রিবার অন্তর্ভুক্ত নয়।

  6. আমরা যে ইমারজেন্সি বেলেন্স নেই সেখানে টাকা ভরার পর অতিরিক্ত কিছু টাকা তারা কেটে নেয় সেটা কি রিবা হবে

    1. না, এটা রিবা নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

সাম্প্রতিক পোস্ট সমূহ
ক্যাটাগরি সমূহ
ট্যাগ সমূহ
error: অনুগ্রহ করে লেখাটি কপি করবেন না। লিংক শেয়ার করুন। ধন্যবাদ