Post Updated at 10 Apr, 2024 – 10:35 PM

ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে মাহে রমজান। সামনেই ঈদ। ঈদ মানেই তো খুশি। রমজানের সিয়াম সাধনায় যেমন সাদা-কালো আর ধনী-গরীবের কোনো ভেদাভেদ নেই, তেমনি রমজানের শেষে ঈদের উৎসবেও উঁচু-নিচুর কোনো ফারাক নেই। প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যেমন সকল মুসলমানের জন্যে সর্বজনীন, সমাজের সকল স্তরের মানুষ একই কাতারে দাঁড়িয়ে যায় আপন প্রভুর বন্দেগিতে, তেমনি ঈদের নামাজের জামাতেও সকলেই শরিক হয়। নামাজ শেষে পরস্পরের কোলাকুলি, দেখা-সাক্ষাতে একে অন্যকে ‘ঈদ মোবারক’ বলে ঈদের শুভেচ্ছায় সিক্ত করা—এ তো ঈদের দিনের স্বাভাবিক ও পরিচিত দৃশ্য। এই যে আনন্দ, এই উৎসব—এটা আমাদের মহান দয়াময় প্রভুর পক্ষ থেকে রমজানের মাসব্যাপী সাধনার একটি নগদ পুরস্কার। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাণী শুনুন—

لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّه

 

রোজাদারের জন্যে দুটি আনন্দ, একটি রোজার শেষে, আরেকটি আপন প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের মুহূর্তে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৫১]

দুনিয়াতে ইবাদত করলে পরকালে এর পুরস্কার পাওয়া যায়—এটাই তো স্বাভাবিকতা। কিন্তু পরকালীন পুরস্কারের সঙ্গে এভাবে হাতেনাতেও একটি পুরস্কার পেয়ে যাওয়া—এ ক্ষেত্রে রোজা অনন্য। পুরস্কার যেমন অনন্য, এর বৈশিষ্ট্যও অন্য সকল ইবাদতের চেয়ে স্বতন্ত্র। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلاَّ الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِى وَأَنَا أَجْزِى بِهِ يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِى

আদমসন্তানের প্রতিটি আমলের প্রতিদান দশগুণ থেকে সাতশগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন : তবে রোজা ছাড়া, কেননা তা আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দেব; আমার জন্যেই বান্দা তার চাহিদা-প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে আর খানাপিনা ছেড়ে দেয়।’ [প্রাগুক্ত]

স্বাতন্ত্রের অধিকারী এ ইবাদতের আরেক স্বতন্ত্র পুরস্কার—বান্দার সকল আমলের প্রতিদান দশগুণ থেকে সাতশগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু রোজার বিষয়টি ভিন্ন। রোজার পুরস্কার তাহলে কী? কতগুণ তা বাড়ানো হবে? আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ প্রতিদানকে কোনো সংখ্যায় আটকে রাখেন নি। সংখ্যার বন্ধন থেকে মুক্ত করে ঘোষণা করেছেন—রোজা আমারই জন্যে, এর প্রতিদান আমিই দেব। কথা সহজ—যিনি যত বড় দাতা, তার দানও তো তত বড়ই হবে। নিজ হাতে আল্লাহ তায়ালা যে পুরস্কার দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন তা আমাদের পরকালকে কত সমৃদ্ধ করতে পারে, তা কি আমরা কল্পনা করতে পারি?

রমজান মাসকে বলাই হয় সংযমের মাস। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

هو شهر الصبر و الصبر ثوابه الجنة

রমজান হলো সবর ও ধৈর্যের মাস আর সবরের প্রতিদান হলো বেহেশত। [সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস : ১৮৮৭]

এ সবর আর সংযমের প্রশিক্ষণই আমরা নিয়ে থাকি রমজান থেকে। খুব স্বাভাবিক কথা, মাসব্যাপী কষ্টকর সিয়াম সাধনা আমাদেরকে যে সংযমের শিক্ষা দিয়ে যায়, যে সংযমের পুরস্কার হিসেবে বেহেশতের কথা রয়েছে, সে সংযমকে অবশ্যই আমাদের জীবনে সারা বছর ধারণ করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আমাদের থেকে যখন এ পবিত্র মাসটি বিদায় নেয় তখন যেন আমরা মাসব্যাপী অর্জিত সংযমটুকুও বিদায় করে দিই। উচ্ছাস আর আনন্দের বাধভাঙ্গা স্রোতে যেন ভেসে যায় আমাদের সকল অর্জন। এরপর তো যে-ই সে-ই—সংযমের শিক্ষা হারিয়ে আমাদেরও যেন হারিয়ে যেতে আর নেই মানা।

জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ইসলামের শিক্ষা মূলত সংযমের। এখানে বাধ ভেঙ্গে দেয়ার অবকাশ নেই। ‘আমার ভোট আমি দেব’র গণতান্ত্রিক শ্লোগানের মতো ‘আমার সম্পদ আমার ইচ্ছা, যেখানে খুশি উড়িয়ে দেব’ কিংবা ‘যেভাবে খুশি বাড়াতে থাকব’ এসব পুঁজিবাদী শ্লোগানও এখানে অচল। ইসলাম আমাদের পদে পদে সীমা টেনে দিয়েছে। যেখানে যাই, যেদিকে যাই, সর্বত্রই সে সীমা মেনেই যেতে হবে। সীমার সুতো পেরিয়ে যাওয়ার অধিকার নেই আমাদের। আল্লাহ তায়ালার বিধান আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ মেনে সে সীমার ভেতর নিজেদের আটকে রাখাই হলো প্রকৃত বন্দেগি। মুমিনের সফলতা খুঁজে পাওয়ার এ পথই একমাত্র পথ। দ্বিতীয় কোনো পথে চললে মুমিনের মুক্তি ও সফলতার কোনো সম্ভাবনা নেই।

ঈদের আনন্দের কথা বলছিলাম। মুসলমানদের জীবনে সবচেয়ে বড় উৎসব এই ঈদুল ফিতর। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় হিজরত করে এলেন, তখন সেখানকার লোকেরা দুটি ভিন্ন ভিন্ন দিনে খেলাধুলা করত। তিনি তাদেও জিজ্ঞেস করলেন : এ দুটি দিন কীসের? তারা বলল : আমরা জাহেলি যুগে এ দুটি দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন :

إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَبْدَلَكُمْ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا يَوْمَ الأَضْحَى وَيَوْمَ الْفِطْرِ

নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্যে এ দুটি দিনকে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দিয়ে পরিবর্তন করে দিয়েছেন⸺ঈদুল আযহার দিন ও ঈদুল ফিতরের দিন। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১১৩৬]

ঈদ যেহেতু আমাদের উৎসব, তাই এ ঈদে আমরা আনন্দ করতেই পারি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের ঈদ-উৎসব অন্য আরও দশটি জাতির উৎসবের মতো নয়। ওই যে বলে আসলাম, আমরা যারা ইসলামের অনুসারী, আমাদের জন্যে বাধ ভেঙে দেয়ার, সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আনন্দের মধ্যেও রয়েছে সীমা। এ সীমার ভেতরেই আমাদের থাকতে হবে। শুধু কি তাই, আমাদের এ আনন্দ-উৎসবটিও মহান রাব্বুল আলামিনের প্রতি শোকর আর কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ থাকে। আমাদের উভয় ঈদের প্রধান আকর্ষণ⸺ধনী-গরীব ছোট-বড় সবাই মিলেমিশে একই কাতারে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা। ঈদের নতুন জামাকাপড় তো আমরা ঈদের জামাতে শরিক হতে গিয়েই পরে থাকি। আমাদের আনন্দ প্রকাশেও তাই কৃতজ্ঞতাটাই মূল। এর পাশাপাশি আনন্দ প্রকাশকেও ইসলাম নিষেধ করে না।

তবে কথা একটাই⸺তা হতে হবে শরিয়ত কর্তৃক প্রদত্ত বৈধতার সব সীমা মেনে। একবার ঈদুল ফিতরের দিনে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. এর ঘরে কয়েকজন বালিকা সংগীত গাইছিল। এমন সময় সেখানে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এলেন। তিনি এসব দেখেই বলে উঠলেন⸺আল্লাহর রাসূলের ঘরে এসব কী হচ্ছে? হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাকে থামালেন এ বলে⸺

يَا أَبَا بَكْرٍ إِنَّ لِكُلِّ قَوْمٍ عِيدًا وَهَذَا عِيدُنَا

আবু বকর! (ওদের কিছু বলো না।) প্রত্যেক জাতিরই একটি খুশির দিন আছে। আর আজকের দিন আমাদের ঈদের দিন, খুশির দিন। [সহীহ বুখারী, হাদীস : ৯৫২]

কথা ওই একটাই⸺ইসলাম যতটুকু আনন্দ প্রকাশ আমাদের জন্যে বৈধ করেছে, ততটুকুই আমরা করতে পারব। এরচেয়ে বেশি আনন্দ প্রকাশের সুযোগ আমাদের নেই। এটাই হচ্ছে বন্দেগি ও দাসত্ব। আনন্দ প্রকাশেও মেনে চলতে হয় মহান প্রভুর নির্দেশনা। এ নির্দেশনা যদি আমরা ঈদের আনন্দে মেনে চলতে পারি, তাহলে বছর জুড়ে রমজানের সংযম-সাধনার অর্জন ছড়িয়ে দেয়া যাবে সহজেই। এ ঈদই হচ্ছে রমজান মাসের সংযম-সাধনা আর সারা বছরের মধ্যে এক সংযোগ-সেতু। কিন্তু একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদের দিনেই যদি আমরা আমাদের এক মাসের অর্জনকে হারিয়ে বসি, সারা বছর তাহলে চলব কী করে? ঈদের দিনটিই যখন পাপে আর পাপে ভরে যায়, এর পরের দিন তাহলে কী হবে? অথচ দুঃখজনক বাস্তবতা এমনই।

ঈদের জামাতে তো আমরা ঠিকই শরিক হই। কিন্তু সকাল পেরিয়ে যখন বিকাল আসে তখনই দেখা যায় নারীদের পর্দাহীন চলাফেরা। অন্যসময় যারা কিছুটা পর্দা মেনে চলেন ঈদের আনন্দে তারাও যেন পর্দার কথা ভুলে যান। চলে আরও হরেক রকম গোনাহের কাজের মহরা। কোথাও বাজতে থাকে উচ্চ শব্দে নাজায়েজ গানবাজনা। পরের দিন থেকে শুরু হয় উৎসবের এক ভিন্ন আমেজ। বিভিন্ন পার্টি আর আনন্দভ্রমণের নামে চলে আরও অনেক অন্যায় কাজকর্ম। ইসলাম যেখানে এক পবিত্র আনন্দের বিধান দিয়েছিল, সেই পবিত্রতাকে কত জঘন্যভাবেই না আমরা কলুষিত করছি!

এবারে আসি নতুন কাপড়ের প্রসঙ্গে। ঈদে নতুন কাপড়চোপড় পরতে ইসলাম নিষেধ করে না। উৎসবে-অনুষ্ঠানে নতুন কিংবা পরিষ্কার পোশাক-আশাক পরা, একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানানো যেমন একদিকে সুস্থ মনের দাবি, তেমনি তা ইসলামেরও শিক্ষা। কিন্তু ওই যে বললাম সীমার কথা, ঈদের আনন্দ উদযাপনেও আমাদেরকে সীমা মেনেই চলতে হবে। সীমা মেনে চলতে পারলেই না আমাদের এই ঈদ ইসলামি ঈদ হবে।

আমাদের ঈদের কেনাকাটায় একটা নতুন সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিজাইনের নতুনত্ব। নতুনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তো আর নতুন কোনো বিষয় নয়। আরবিতে প্রবাদই আছে—কুল্লু জাদীদিন লাযীয অর্থাৎ নতুন সবই স্বাদের। তাই নতুন ডিজাইনের পোশাক আপনি কিনতেই পারেন। এটাকে নিন্দার চোখে দেখার খুব একটা সুযোগ নেই। কিন্তু নিন্দার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন, যখন কোনো নায়ক-নায়িকা অভিনেতা-অভিনেত্রীর পোশাকের ডিজাইনে বাজার ছেয়ে যায়। মানুষ হুমরি খেয়ে পড়ে সেসব পোশাকের জন্যে। সে পোশাক না হলে যেন ঈদের আনন্দ ছাই হয়ে যাবে। বিক্রেতারাও সুযোগ বুঝে পাঁচশ টাকার পোশাকের দাম বসিয়ে দেন পাঁচ হাজার টাকা। দাম যাই হোক না কেন, পোশাকটি তো চাই-ই।

এই যে একজন অভিনেতা কিংবা একজন গায়িকার পোশাক দেখে আকৃষ্ট হওয়া—ইসলাম এখানেই আমাদের আটকে দিয়েছে। ইসলামের শিক্ষা হলো, অনুসরণ যদি করতে চাও তাহলে নেক লোকদের অনুসরণ করো। যদি কাউকে ভালোবাসতে চাও, ভালো মানুষদেরই ভালোবাসো। তাহলে কেয়ামতের দিন তুমি তাদের সঙ্গে থাকতে পারবে। হযরত আনাস রা. এর বর্ণনা, একবার এক লোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বলল : ইয়া রাসূলুল্লাহ, কেয়ামত হবে কখন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন নামাজ পড়তে চলে গেলেন। নামাজ শেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন : কেয়ামতের কথা যে জানতে চেয়েছিল সে লোকটি কোথায়?
: আমিই ইয়া রাসূলুল্লাহ।
: তুমি কেয়ামতের জন্যে কী প্রস্তুতি নিয়েছ?
: ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি তো বেশি বেশি নামাজ-রোজা করতে পারি না, তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি।

তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন :

الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ وَأَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ

অর্থাৎ মানুষ যাকে ভালোবাসে, (কেয়ামতের দিন) সে তার সঙ্গেই থাকবে। তুমিও যাকে ভালোবাস, তার সঙ্গেই তুমি থাকবে।

হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আনাস রা. বলেন, প্রিয় নবীজির মুখ থেকে এ কথা শুনে মুসলমানগণ এতটাই খুশি হয়েছেন, যেমনটা তারা আগে আর কখনো হন নি। [জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৩৮৫]

ইসলামে এই হলো ভালোবাসার গুরুত্ব ও প্রাপ্তি। পরকালই যেখানে মুমিনের আসল চাওয়া-পাওয়া, তাই পরকালকে সমৃদ্ধ করার পথে সে চলবে—এটাই তো বুদ্ধি ও বিবেকের দাবি। কিন্তু আমরা এখানে এসেই পথ হারিয়ে বসেছি। অশ্লীলতা আর পাপের প্রচার-প্রসারে যাদের দিন-রাত উৎসর্গিত তাদেরই কিনা আমরা আদর্শ হিসেবে বেছে নিচ্ছি। তাদের পোশাক-আশাক আমাদের কাছে যেন পরম আরাধ্য। সন্দেহ নেই, পরকালীন মুক্তি পেতে হলে এ খাঁদ থেকে আমাদের উঠে আসতেই হবে।

আদর্শ যাই হোক, কেনাকাটার বিষয়টিও এখন এক সংকট। রমজান মাস যতই বিদায়ের দিকে এগিয়ে যায়, মুমিন বান্দাদের ততই রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় অধিক যতœবান হওয়া উচিত। ভরপুর নেকি হাসিলের এ মৌসুমের শেষ দিনগুলোও জমিয়ে তোলা উচিত ইবাদতে আর ইবাদতে। তেলাওয়াত-জিকির-নামাজ-দোয়া-কান্নাকাটি ইত্যাদিই হওয়া চাই তখনকার একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু ঈদের কেনাকাটা যেন আমাদের সব ইবাদতকে বানের পানির মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কাপড়চোপরের দোকানপাটে মহিলাদের ভিড় তখন এতটাই প্রকট, শুধুই পুরুষদের দোকান না হলে একজন ভদ্র পুরুষের পক্ষে তখন ঈদের কেনাকাটা করাও কঠিন হয়ে পড়ে।

এরপর আসে দামের প্রসঙ্গ। কারও সামর্থ্য কম থাকলে সে দুই-তিনশ টাকার জামা কিনবে। কারও বেশি থাকলে তার জামার দাম হবে কয়েক হাজার টাকা। মোটকথা, জামাকাপড় কেনার ক্ষেত্রে যার যা সামর্থ্য, সে অনুযায়ীই চলবে। ইসলামের শিক্ষাও এমনি। ভালো কাপড়চোপড় পড়ার সাধ্য যার আছে, সে কমদামী কিংবা ছেড়া-ফাটা কোনো কাপড় পরে থাকবে—এটা ইসলামের শিক্ষা নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা কত বিস্তৃত! তিনি বলেছেন—

إِنَّ اللَّهَ يُحِبَّ أَنْ يَرَى أَثَرَ نِعْمَتِهِ عَلَى عَبْدِه

আল্লাহ তায়ালা তাঁর যে বান্দাকে যে নেয়ামত দেন নিশ্চয়ই তিনি তার প্রকাশ দেখতে ভালোবাসেন। [জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৮১৯]

একবার প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এক সাহাবী হযরত আবুল আহওয়াস রা.কে জীর্ণশীর্ণ কাপড় পরা অবস্থায় দেখলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন : তোমার কি ধন-সম্পদ আছে?
: উট-বকরি সব রকম সম্পদই আল্লাহ তায়ালা আমাকে দান করেছেন।
: তাহলে তোমার মাঝে যেন সে সম্পদ প্রকাশ পায়। [জামে তিরমিযী, হাদীস : ২০০৬]

এটাই ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু সমস্যা তখনই, যখন এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয়। অনেকের কাছেই এখন কাপড়ের গুণগত মানের পরিবর্তে ‘অমুক মার্কেট’ কিংবা ‘অমুক শপিং মল’ থেকে কেনাটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রেতারা যেমন, বিক্রেতারাও তেমন। তারাও তিনশ টাকার কাপড় হেসেখেলেই ক্রেতার হাতে তুলে দিচ্ছে দুই-আড়াই হাজার টাকায়। ঈদ এলে এ অবস্থা যেন পাহাড়ের উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে যায়। তখন আর আধুনিক বিপনীবিতানগুলো নয়, ছোটবড় সব মার্কেটেই তখন যেন এটাই স্বাভাবিকতা। ভালো কাপড়ের ভিড়ে অনেক নিম্মমানের কাপড়ও মুখরোচক কথায় প্ররোচিত করে অহরহই ক্রেতাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস উল্লেখ করছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার বিক্রয়ের জন্যে রাখা এক খাদ্য-স্ত‚পের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। স্তুপ দেখে তিনি এর ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। দেখলেন, ভেতরের পণ্যগুলো ভেজা। স্তুপের মালিককে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন : কী ব্যাপার, এগুলো কী? সে উত্তর দিল : ইয়া রাসূলুল্লাহ, বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : তুমি এগুলো উপরে রেখে দিলে না কেন, তাহলে তো ক্রেতারা তা দেখে নিতে পারত? যে ধোঁকা দেয় সে তো আমাদের দলভুক্ত নয়। [সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১০২]

বছর ঘুরে যে রমজান আমাদের মাঝে আসে গোনাহ থেকে মুক্তির পয়গাম নিয়ে, আমাদের নিজেদেরকে তাকওয়ার সাজে সজ্জিত করার আহ্বান নিয়ে, সে রমজানের পবিত্র দিনগুলোতেই দেখা যাচ্ছে—আমরা হারিয়ে যাচ্ছি গোনাহের অন্ধকারে। বেচাকেনার ধুমে যেন নামাজ পড়ারও সুযোগ করতে পারছি না। এর সঙ্গে সংযমের সীমা তো লঙ্ঘন করছিই। রহমত-বরকত মুক্তি আর মাগফেরাতের মাস পবিত্র রমজানে আমরা যদি নিজেদের জীবন স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করে তুলতে চাই, তাহলে সংযমের এ ভাঙন রোধ করতেই হবে। রোজার শিক্ষা কেবল তখনি ছড়িয়ে পড়তে পারে আমাদের পুরো জীবনব্যাপী।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

- আমি মুসলিমস ডে এর কমেন্টের নীতিমালার সাথে একমত হয়ে পোস্ট করছি

সাম্প্রতিক পোস্ট সমূহ
ক্যাটাগরি সমূহ
ট্যাগ সমূহ
error: অনুগ্রহ করে লেখাটি কপি করবেন না। লিংক শেয়ার করুন। ধন্যবাদ