Post Updated at 26 Aug, 2024 – 12:52 PM
সারা দেশ এক যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আকস্মিক বন্যায় আক্রান্তদের সহায়তা করার জন্যে। যে বা যারা যেভাবে পারছে ফান্ড কালেকশন করছে, ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করছে, পৌঁছে দিচ্ছে আক্রান্তদের কাছে। বড় ও পরিচিত নানা এনজিওগুলো এগিয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে সাড়া ফেলে দিয়েছে আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন। আরও অনেকেই এগিয়ে এসেছে। মসজিদের মিম্বরগুলো থেকে আহ্বান করা হচ্ছে আক্রান্ত ভাইবোনদের পাশে দাঁড়াতে। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও নিজেদের মতো করে টাকা সংগ্রহ করছে। সরকারের পক্ষ থেকেও ঘোষণা এসেছে। অনেক চাকরিজীবী নিজেদের একদিনের বেতন, কেউ কেউ একমাসের বেতনও দিয়ে দিচ্ছেন। স্কুল-কলেজ-মাদরাসার ছাত্ররা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে বক্স হাতে করে, বন্যার্তদের সহযোগিতার জন্যে। এ সব উদ্যোগই প্রশংসনীয়, সন্দেহ নেই। আল্লাহ তাআলা সবার নেক উদ্যোগকেই কবুল করুন।
দানের ফযিলত
কোনো অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, বিপদগ্রস্তকে সহায়তা করা- এসব তো ধর্ম ও সমাজ উভয় দৃষ্টিতেই পরম কাঙ্ক্ষিত বিষয়। এখানে যে পিছিয়ে থাকে, নিন্দার তীরে সে আক্রান্ত হবেই। বন্যায় এ মুহূর্তে যারা আক্রান্ত, তারা যে কতটা অসহায়—তা বলাবাহুল্য। আশ্রয়শিবিরে যারা আশ্রয় নিয়েছে, তাদের অনেককে গবাদি পশুপাখির সঙ্গে একই রুমেও থাকতে হচ্ছে। ক্ষুধার যন্ত্রণা তো আছেই। যারা এখন আক্রান্ত, তাদের অনেকেই হয়তো স্বাভাবিক জীবনে সচ্ছল ছিল, বাড়ি-টাকাপয়সা-ব্যাংকব্যালেন্স ইত্যাদি অনেক কিছুই ছিল বা আছে, কিন্তু এসব থেকেও যেন এখন নেই। এমন অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো ঈমানের দাবি, বিবেকের দাবি। অসহায়ের পাশে যে দাঁড়ায় না, অসুস্থকে যে সেবা করে না, অভাবীকে যে সাহায্য করে না, তার জন্যে কতটা ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে, হাদীসের ভাষায় তা পড়ুন-
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَا ابْنَ آدَمَ مَرِضْتُ فَلَمْ تَعُدْنِى. قَالَ يَا رَبِّ كَيْفَ أَعُودُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ. قَالَ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ عَبْدِى فُلاَنًا مَرِضَ فَلَمْ تَعُدْهُ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ عُدْتَهُ لَوَجَدْتَنِى عِنْدَهُ يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَطْعَمْتُكَ فَلَمْ تُطْعِمْنِى. قَالَ يَا رَبِّ وَكَيْفَ أُطْعِمُكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ. قَالَ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّهُ اسْتَطْعَمَكَ عَبْدِى فُلاَنٌ فَلَمْ تُطْعِمْهُ أَمَا عَلِمْتَ أَنَّكَ لَوْ أَطْعَمْتَهُ لَوَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِى يَا ابْنَ آدَمَ اسْتَسْقَيْتُكَ فَلَمْ تَسْقِنِى. قَالَ يَا رَبِّ كَيْفَ أَسْقِيكَ وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ قَالَ اسْتَسْقَاكَ عَبْدِى فُلاَنٌ فَلَمْ تَسْقِهِ أَمَا إِنَّكَ لَوْ سَقَيْتَهُ وَجَدْتَ ذَلِكَ عِنْدِى.
কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বলবেন,
হে আদমসন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাও নি। সে বলবে, হে আমার প্রভু! আমি কীভাবে আপনাকে দেখতে যাব, আপনি যে বিশ্বজগতের প্রভু! তিনি বলবেন, তুমি কি জান না, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল আর তুমি তাকে দেখতে যাও নি? তুমি কি জান না, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে তাহলে আমাকে তার কাছে পেতে?
হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাও নি। সে বলবে, হে প্রভু! আমি কী করে আপনাকে খাওয়াব, আপনি তো রাব্বুল আলামিন! তিনি বলবেন, তুমি কি জান না, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, তখন তুমি তাকে খেতে দাও নি? তুমি কি জান না, তুমি যদি তাকে খাওয়াতে, তাহলে তা আমার কাছে পেতে?
হে আদমসন্তান! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি দাও নি। সে বলবে, হে প্রভু! কীভাবে আমি আপনাকে পানি খাওয়াব, আপনি তো সারা জাহানের প্রভু! তিনি বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে পানি দাও নি। তুমি যদি তাকে পানি খাওয়াতে, তা আমার কাছে পেতে?
-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৬৯
আসলে আমরা ভয় পাই দারিদ্রকে। এ ভয় থেকেই আঁকড়ে থাকি আমাদের উপার্জিত সব সম্পদ। নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা, সন্তানের ভবিষ্যত-চিন্তা ইত্যাদি আমাদেরকে সম্পদ ব্যয়ে নিরুৎসাহিত করে। অথচ হাদীস শরীফে উচ্চারিত হয়েছে একই সঙ্গে সুসংবাদ ও সতর্কবার্তা। একটি যে সম্পদ ব্যয় করে তার জন্যে, আরেকটি যে সম্পদ জমিয়ে রাখে তার জন্যে। লক্ষ করুন-
مَا مِنْ يَوْمٍ يُصْبِحُ الْعِبَادُ فِيهِ إِلاَّ مَلَكَانِ يَنْزِلاَنِ فَيَقُولُ أَحَدُهُمَا اللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا وَيَقُولُ الآخَرُ اللَّهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا.
প্রতিদিন সকালেই দুইজন ফেরেশতা নেমে আসে। তাদের একজন দোয়া করে- হে আল্লাহ! যে সম্পদ ব্যয় করে তাকে আপনি এর বদলা দান করুন। অপরজন বলে- হে আল্লাহ! যে সম্পদ জমিয়ে রাখে তাকে ধ্বংস করে দিন।
-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৪৪২
তাই আসুন, আমরা বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াই। যার যতটুকু সামর্থ আছে, তা নিয়েই এগিয়ে যাই। আল্লাহ তাআলার কাছে দানের পরিমাণ বিবেচ্য নয় কখনোই, তিনি দেখেন দাতার নিয়ত ইখলাস ও আন্তরিকতা। ইখলাস ও আন্তরিকতার সঙ্গে সামান্য দান অনেক সময় ছাড়িয়ে যেতে পারে পাহাড়সম দানকেও।
দান ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিবেচ্য কয়েকটি বিষয়
১. বর্তমান বন্যা-পরিস্থিতি এবং এ ধরনের যে কোনো পরিস্থিতিতে যারা সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন, আমরা বিশ্বাস করতে চাই, তারা বিবেক ও মানবতার দাবি এবং দীনের নির্দেশনা পূর্ণ করার জন্যেই নিজেদের জান-মাল ব্যয় করে থাকেন। তবে দান ও সহযোগিতা যেন উপযুক্ত ক্ষেত্রে হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
২. অনেকেই এখন ফান্ড কালেকশন করছেন। ছোট-বড় নানারকম উদ্যোগ আমরা এখন দেখছি। এমনটা আগেও ছিল। শীত বন্যা ঘূর্ণিঝড় এমন যে কোনো সংকটেই আলেম-উলামা এবং সাধারণ মানুষ সকলেই এগিয়ে এসেছেন। তবে এ কালেকশনের ক্ষেত্রে কোনোরূপ সীমালঙ্ঘন যেন না হয়, শরিয়তের কোনো বিধান যেন লঙ্ঘিত না হয়, সে দিকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। যেমন, কাউকে দান করতে বাধ্য করা হলো, কিংবা কারও কাছ থেকে জোর করে সহযোগিতা নেয়া হলো ইত্যাদি। এগুলো জায়েয নয়। আর নিজে পাপে জড়িয়ে কাউকে সহযোগিতা করার কোনো শিক্ষা ও নির্দেশনা ইসলামে নেই।
৩. প্রায়ই দেখা যায়, বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা লটারির আয়োজন করে। তারা ঘোষণাও করে—লটারির পুরস্কার দেয়ার পর যে টাকা থেকে যাবে তা দিয়ে এ ধরনের কোনো সহযোগিতা করা হবে। কেউ কেউ আবার সহযোগিতার জন্যে কনসার্ট বা এ জাতীয় কোনো আয়োজন করে। সে আয়োজনের যাবতীয় আয় তারা অসহায়দের বা বিপন্নদের দিয়ে দেয়। লক্ষ্য অবশ্যই ভালো, সন্দেহ নেই। কিন্তু একজন মুসলমান কি এ আয়োজন করতে পারেন, কিংবা এমন আয়োজনে শরিক থাকতে পারেন? একজন ঈমানদার কি অসহায়দের সহযোগিতার নিয়তে একটি লটারির টিকেট কিনতে পারেন? না, পারেন না। কারণ লটারি, নাচ-গান শরিয়তে হারাম। হারাম কাজের আয়োজন ও সহযোগিতাও হারাম। আর অসহায় কাউকে সহযোগিতা করার জন্যে নিজে হারাম কাজে জড়ানোর সুযোগ নেই। বৈধ ও শরিয়তসম্মত পন্থায় যতটুকু সহযোগিতা করা যায়, ততটুকুই করা উচিত। সেখানে কার্পণ্য করা উচিত নয়।
৪. এমনও শোনা যাচ্ছে, কোনো কোনো মসজিদে জুমার নামাজের সময় মসজিদের জন্যে যে কালেকশন করা হয়, এক সপ্তাহের পুরো কালেকশনটাই মসজিদ কর্তৃপক্ষ বন্যার্তদের সহযোগিতায় দিয়ে দিচ্ছেন। এখানেও মসজিদ কমিটির আবেগ প্রশংসনীয়। তবে পদ্ধতিটি শরিয়তসম্মত নয়। মুসল্লিরা যে টাকা মসজিদের ফান্ডে দান করেছে, সে টাকা মসজিদের কোনো প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোথাও ব্যয় করার অধিকার মসজিদ কমিটি কিংবা মুতাওয়াল্লী—কারোরই নেই। হ্যাঁ, এরকম পরিস্থিতিতে মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে কিংবা অন্য যে কারও উদ্যোগে আলাদাভাবে কালেকশন করা যেতে পারে। এতে অসুবিধা নেই।
৫. সহযোগিতার জন্যে ফান্ড কালেকশন থেকে সহযোগিতা-বিতরণ পর্যন্ত প্রতিটি কাজই পরিকল্পনামাফিক হওয়া উচিত। এতে তুলনামূলক অধিক সংখ্যক মানুষকে সেবার আওতায় আনা যাবে। বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকজন কিছু টাকা বা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে কোনো এক জায়গায় বিলিয়ে না এসে যদি সে টাকা বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে অর্পণ করা হয় তাহলে এতে তুলনামূলক বেশি উপকার হতে পারে। বড় প্রতিষ্ঠানের ফান্ড যত বৃদ্ধি পাবে, তাদের সহযোগিতার পরিসরও ততই বাড়বে। বিক্ষিপ্তভাবে সহযোগিতা নিয়ে গেলে হয়তো এ সুযোগ পাওয়া যাবে না। বরং কিছু মানুষ অনেকের কাছ থেকেই কিছু পেতে পারে, কেউ কেউ আবার কারও কাছ থেকেই কিছু নাও পেতে পারে। তাই প্রয়োজন সমন্বয় ও পরিকল্পনা।
৬. আবেগের বশবর্তী হয়েই কেউ কেউ ভাবে—আমি নিজে গিয়ে সেখানকার অসহায় ভাইবোনদের হাতে সহযোগিতা তুলে দেব। চিন্তাটা ভালো, প্রশংসনীয়, কিন্তু এর চেয়েও দরকারি কথা হলো, অনেক ক্ষেত্রে আপনার একার বা আপনাদের কয়েকজনের যাতায়াতের টাকা দিয়ে ওখানকার হাজারো মানুষের একবেলার খাবারের ব্যবস্থা হতে পারে। আবার প্রতিকূল পরিস্থিতির ধারণা ও সহযোগিতা বিতরণের অভিজ্ঞতা না থাকলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। এ বিষয়গুলোও লক্ষণীয়।
৭. বন্যাপরবর্তী পরিস্থিতির জন্যেও এখন থেকেই পরিকল্পনা দরকার। এখন প্রয়োজন হয়তো কেবলই খাদ্রসামগ্রীর। সন্দেহ নেই, বেঁচে থাকার জন্যে এটা অপরিহার্য। কিন্তু বন্যার পানি সরে গেলে হাজার হাজার ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি নতুন করে মেরামত বা সংস্কারের প্রয়োজন হবে। আবার খাদ্যসামগ্রীও লাগবে। তখন আরও অনেক বেশি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে। এজন্যেও পরিকল্পনা ও সমন্বয় জরুরি।
৮. সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে দুটি শ্রেণির প্রতি বিশেষ নজর দেয়া উচিত। এক. আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠজন। তাদের কেউ যদি সেখানে আক্রান্ত ও অসহায় অবস্থায় থাকে, তবে আত্মীয় ও আপনজন হিসেবে সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা অধিক হকদার। এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিত। দুই. আলেমসমাজ ও সমাজের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ। শত বিপদের মুখেও তারা হয়তো নিজেদের প্রয়োজনের কথা মুখে উচ্চারণ করতে পারবেন না। এ সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারাও বিশেষ হকদার। প্রয়োজনে খোঁজ নিয়ে হলেও এমন লোকদের পাশে দাঁড়াতে হবে।